নয়া শতাব্দী অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি।
টাকা-পয়সা, ধনদৌলত, জাগতিক সম্মান ও জৌলুসপূর্ণ জীবন অতিবাহিত করতে পারাকে আমরা জীবনের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি ও আসল শান্তি মনে করি। জীবনের সবটুকু দিয়েই আমরা তা অর্জন করতে চাই।
কীভাবে অনেক বেশি টাকা রোজগার করা যাবে, কীভাবে অন্যকে টপকে উপরে উঠা যাবে, কীভাবে নিজের সব কিছুকে সবচেয়ে বেশি সুন্দরভাবে উপস্থাপন করা যাবে, কীভাবে সব সময়ই অন্যের থেকে প্রশংসা পাওয়া যাবে, এসব চিন্তায় আমরা বিভোর থাকি।
এই যে এতো এতো পাওয়ার আকাঙ্ক্ষাই আমাদের মানসিক প্রশান্তি নষ্ট করার জন্য যথেষ্ট। এগুলো নিয়ে সারা দিন ব্যস্ত থাকার কারণে কখন যে শান্তির সন্ধানের সঠিক সময়গুলো চলে যায় তা আমাদের মনেই আসে না।
মানবজীবনের সবচেয়ে বড় উপহার কী? বেশ কয়েকজন ব্যক্তিকে যদি এ প্রশ্নটি করা হয় তাহলে একেকজনের থেকে একেক উত্তর আসবে। তবে বতর্মান সময় বিবেচনায় আমার মনে হয় যে, প্রশ্ন করা বেশির ভাগ ব্যক্তি থেকেই হয়তো যে উত্তরটি আসবে তা হলো ‘মানসিক প্রশান্তি’।
পুঁজিবাদী এ সমাজের প্রতিটি মানুষ মুখে প্রকাশ করতে না পারলেও ঠিকই অনুধাবন করতে পারে যে মানসিক প্রশান্তি আল্লাহতায়ালার দেয়া কত বড় নেয়ামত। এই প্রশান্তি লাভের আশায় আমরা বিভিন্ন পর্যটন স্থানে ভ্রমণসহ আরও কত কাজই না করে থাকি। কত মানুষ তো আবার পাপের পথে মানসিক প্রশান্তির সন্ধান করে। কিন্তু দিন শেষে তারা কেউই পরিপূর্ণ মানসিক প্রশান্তির সন্ধান পায় না!
তাহলে কোথায় পাওয়া যাবে এই অমূল্য সম্পদ? যা পেতে মানুষ হাজারো কোটি টাকা অনায়াসে খরচ করে ফেলছে তবুও তা লাভে সক্ষম হচ্ছে না? বস্তুত, মানসিক প্রশান্তি ও ইবাদতের স্বাদ উপলব্ধি করার প্রক্রিয়া একই সুতোয় বাঁধা।
মানুষের হূদয়ে যখনই ঈমানের নূর চমকাবে তখনই সে পরিপূর্ণভাবে মানসিক প্রশান্তি লাভ করবে। তখন পৃথিবীর কোনো সম্পদ, সুনাম, নাম, জশ ইত্যাদি না থাকলেও তার মনে হবে তার কাছে যেন ওই সব কিছুই আছে যা তার দরকার। আর ইবাদতের প্রশান্তিই একজন ব্যক্তিকে তার কাঙ্ক্ষিত মানসিক প্রশান্তির পথে নিয়ে যায়।
একজন ব্যক্তি ঠিক তখন থেকেই মানসিক প্রশান্তি হারাতে থাকে যখন থেকে সে তার জন্মগত ফিতরাত অর্থাৎ রবের আনুগত্য হওয়া থেকে দূরে সরে যায়। প্রথমে সে জিকিরে অলসতা শুরু করে, ধীরে ধীরে কুরআন তিলাওয়াতের প্রতি অমনোযোগ চলে আসে, এরপর সালাত ছুটতে শুরু করে, ধীরে ধীরে মেজাজে পরিবর্তন আসে, একা থাকতে ভালোলাগা শুরু হয় যদিও শান্তির আশায় সে সবার সাথে মিলে থাকার চেষ্টা করে, কারোর আদেশ-নিষেধ সহ্য হয় না, পাপের কাজ করার জন্য একটার পর একটা উসিলা বের করতে থাকে, পর্যায়ক্রমে এমন একটা সময় আসে যখন সে আর নিজের অন্তরের কান্না অনুভব করতে পারে না।
প্রতিটি পাপে অন্তরে একটা করে কালো দাগ পড়তে পড়তে অন্তর মরীচিকার আলেয়ায় এমনভাবে ঢেকে যায় যেন তা মেঘে ঢাকা খাঁ খাঁ প্রান্তর। এভাবেই একটা সময় তার অন্তত মরে যায়।
আমরা জানি, খারাপ কাজের শাস্তি মানুষকে দুনিয়া ও আখিরাত উভয় স্থানেই পেতে হবে। যদিও জাহান্নামের মতো দুনিয়ায় চাক্ষুষ কোনো শাস্তি নেই তাই অনেক সময় আমরা এই সত্য অনুধাবন করতে চাই না। কিন্তু এটি এক অপ্রিয় সত্যি যে, খারাপ কাজের শাস্তি আখেরাতের পাশাপাশি দুনিয়াতেও ভোগ করতে হয়। আর এই শাস্তি অনেকটা স্মরণ করিয়ে দেয়ার কাজ করে।
আমাদের করা পাপের ইহলৌকিক শাস্তি হচ্ছে ইবাদতের খুশু-খুযু নষ্ট হয়ে যাওয়া! পাপ করার পর কখনও একজন ব্যক্তি ইবাদতে ততটা আনন্দ ও উৎসাহ পায় না যেমনটা সে সালাফে সালেহিনের জীবনী থেকে জেনেছে। তার কাছে সেগুলোকে শুধুই কাহিনি বলেই মনে হয়।
আল্লাহতায়ালার দিকে পুরোপুরি ফিরে না এলে অর্থাৎ পবিত্র মনে তাওবা না করলে সে আর সেই তৃপ্তি পেতে পারে না যা তার পাওয়ার কথা ছিল। ইবাদতের খুশু-খুযু হারিয়ে যাওয়ার মতো শাস্তি একজন মুসলিমের জন্য আর কিছুই হতে পারে না।
আল্লামা ইবনে রজব (রহ.) বলেন, ‘পাপের অনিবার্য পরিণতি হলো দুশ্চিন্তা, মানসিক কষ্ট, হূদয়ের সংকীর্ণতা ও মন্দ আচরণ, অন্তরের অন্ধকার ও কাঠিন্য এবং ইবাদতের স্বাদ হারিয়ে ফেলা।’ আর আল্লামা ইবনুল কাইয়িম (রহ.) বলেন, ‘পাপের একটি শাস্তি হলো অন্তরের মৃত্যু এবং জিকির, কোরআন তিলাওয়াত, দোয়া ও মোনাজাতে স্বাদ হারিয়ে ফেলা।’ (ইতহাফুল আশিকিন: ৪৩৭)
ইবাদতের পরিপূর্ণ স্বাদ লাভের সবচেয়ে বড় উপায় হচ্ছে ঈমানের পরিপূর্ণতা। আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (সা.) বলেছেন, ‘তিনটি গুণ যার মধ্যে আছে, সে ঈমানের স্বাদ আস্বাদন করতে পারে ১. আল্লাহ ও তাঁর রাসুল তার কাছে সব কিছু থেকে বেশি প্রিয় হওয়া। ২. কাউকে শুধু আল্লাহর জন্যই ভালোবাসা। ৩. কুফরিতে ফিরে যাওয়াকে আগুনে নিক্ষিপ্ত হওয়ার মতো অপছন্দ করা।’ (বুখারি : ১৬)
অন্য হাদিসে এসেছে, ‘সেই ব্যক্তি ঈমানের স্বাদ লাভ করেছে, যে আল্লাহকে প্রতিপালক হিসেবে, ইসলামকে দীন হিসেবে এবং মোহাম্মদ (সা.)-কে নবী হিসেবে পেয়ে সন্তুষ্ট।’ (তিরমিজি : ২৬২৩)
এখন এই কাঙ্ক্ষিত প্রশান্তি যদি আমরা লাভ করতে চাই তাহলে আমাদের সবচেয়ে বড় দায়িত্ব হচ্ছে পবিত্র দিলে আল্লাহতায়ালার কাছে তাওবা করা। ফেলে আসা পেছনের সেই জীবনের জন্য অনেক কষ্ট লাগবে কিন্তু বুঝতে হবে যে, এগুলো শয়তানের কারসাজি। সে-ই চাচ্ছে না আপনি রবের পথে ফিরে আসুন এবং পরিপূর্ণ মানসিক প্রশান্তির সঙ্গে আল্লাহতায়ালার শুকরিয়া আদায় করুন। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করা হয়েছে, ‘তারা তো আদিষ্ট হয়েছিল আল্লাহর আনুগত্যে বিশুদ্ধ চিত্ত হয়ে একনিষ্ঠভাবে তাঁর ইবাদত করতে, নামাজ কায়েম করতে ও জাকাত দিতে; আর এটাই সঠিক দীন।’ (সুরা বাইয়িনাহ: ৫)
ইমাম ইবনুল কাইয়িম (রহ.) বলেন, ‘মানুষের অন্তরে অপূর্ণতা রয়েছে, যা আল্লাহর দিকে ধাবিত হওয়া ছাড়া পূর্ণ হয় না। তাতে হিংস্রতা রয়েছে, যা একান্তে আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন করা ছাড়া দূর হয় না। তাতে দুশ্চিন্তা রয়েছে, যা আল্লাহর পরিচয় লাভ ও তাঁর হকসমূহ আদায় করা ছাড়া দূর হয় না।
তাতে অস্থিরতা রয়েছে, যা থেকে আল্লাহর আনুগত্যের প্রতি দ্রুত এগিয়ে যাওয়া ও তাতে স্থির থাকা ছাড়া মুক্তি পাওয়া যায় না। তাতে আক্ষেপের আগুন আছে, যা তার আদেশ, নিষেধ, সিদ্ধান্ত ও মৃত্যু পর্যন্ত তাঁর সিদ্ধান্তের (ভাগ্যের) ওপর সন্তুষ্টি ছাড়া নেভানো যায় না।’ (তাতিরুল আনফাস মিন হাদিসিল ইখলাস: ৮২)
চিন্তাশক্তি সম্পন্ন প্রতিটি মানুষের অন্তত একবার ভেবে দেখা উচিত সে কি আসলেই সত্যিকার প্রশান্তি ও সমৃদ্ধি লাভ করতে পেরেছে? জাগতিক ঐশ্বর্য ও খ্যাতি কি সত্যিই তাকে পরিপূর্ণ সুখী করতে পেরেছে?
নাকি সত্যিই কোথাও অদৃশ্য কোনো ফাঁকফোকর রয়ে গেছে! রাতে ঘুমানোর আগে অন্তত পাঁচটা মিনিট এ বিষয়ে চিন্তা করলেই অবশ্যই মন বলে উঠবে লৌকিক চাকচিক্য কখনও প্রশান্তির খোরাক নয়। যেই ইসলামের জন্য সালাফে সালেহিন নিজেদের জীবন দিয়ে দিতে দ্বিধাবোধ করেননি সেই ইসলামের প্রতি কেন আমাদের আগ্রহের এতো কমতি? এটা কি সত্যি ভাববার বিষয় নয়? পাপে পূর্ণ এ জীবন যেন কারাগারের থেকে কম কিছুই নয়।
লেখক : শিক্ষার্থী, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ