নয়া শতাব্দী অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি।
আপনারা গুরুত্বপূর্ণ মাস তথা আল্লাহ কর্তৃক হারামকৃত রজব মাসের শেষাংশে অবস্থান করছেন। এটি কল্যাণকর ও বরকতময় মাসসমূহের সূচনা। বছর গাছের সদৃশ; রজব মাসে তার পাতা গজায়, শাবান মাসে তার শাখা-প্রশাখা তৈরি হয় আর রমজান মাসে তার ফল আহরণ করা হয়। আর মুমিনগণ হলো এই ফলের আহরণকারী। এরপরে উম্মুল কুরা মক্কার উদ্দেশ্যে হজের প্রস্তুতি শুরু হবে সামর্থ্যবানদের।
মানুষের হৃদয় বাগানের ন্যায়; পর্যাপ্ত সেচ ও জমিনের আগাছা নির্মূল ব্যতীত তার ফল বৃদ্ধি পায় না। হৃদয়ের সেচ হলো ইস্তেগফার (ক্ষমা প্রার্থনা) করা আর আগাছা নির্মূল হলো তাওবা করা। সুতরাং যে ব্যক্তি তার আমলনামাকে পাপ দ্বারা কলঙ্কিত করেছে তার কর্তব্য হলো, এই দিনগুলোতে তাওবার মাধ্যমে তাকে পরিচ্ছন্ন করা। আর যে অলসতায় তার জীবন নষ্ট করেছে তার কর্তব্য হলো, রাতে তাহাজ্জুদ ও দিনে সিয়াম পালন করা। যে হারাম পরিহার করে চলে সেই শ্রেষ্ঠ ইবাদতগুজার।
কাজেই আপনারা রবের দিকে অগ্রসর হন, তওবার মাধ্যমে তাঁর নৈকট্য অর্জন করুন, ফিরে এসে তাঁর প্রিয় পাত্র হন। আলোর বাগান ও সৎকর্মশীলদের অন্তরের উজ্জ্বলতার দিকে তথা একনিষ্ট তাওবার দিকে কেনই বা অন্তর অগ্রসর হবে না! অথচ বিশ্বপালনকর্তা তাওবাকারীকে তাঁর প্রিয় ব্যক্তি হিসেবে ঘোষণা করেছেন। মহান আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয় আল্লাহ তাওবাকারীকে ভালোবাসেন এবং তাদেরকেও ভালোবাসেন যারা পবিত্র থাকে।’ (সুরা বাকারা : ২২২)
আর আল্লাহ তায়ালা কর্তৃক প্রদত্ত ঐশ্বরিক আনন্দ উপলক্ষে দুর্বল মিসকিন বান্দা কেনই বা উদ্যমী হবে না! অথচ আবু হুরায়রা (রা.) কর্তৃক সহিহ মুসলিমে বর্ণিত হাদিসে নবী (সা.) বলেছেন, ‘মরুপ্রান্তরে তোমাদের কেউ হারোনো (বাহন) পশু পাওয়ার পর যে পরিমাণে খুশি হয়, আল্লাহ বান্দার তাওবার পর থেকেও অধিক খুশি হন।’ (সহিহ মুসলিম)
রবের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন এবং তাঁর প্রতি ভালোবাসা, আকাঙ্ক্ষা, দাসত্ব ও গোলামির সঙ্গে দ্রুত অগ্রসর হওয়াতেই রয়েছে বান্দার প্রকৃত জীবন। আর সর্বোত্তমভাবে দাসত্বের বাস্তবায়ন হয় আল্লাহর কাছে বান্দার তাওবাকারী ও প্রত্যাবর্তনকারী হওয়ার মাধ্যমে। ফলে সে পাপকাজে জড়িত হবে না এবং এটাকে তার চরিত্রও বানাবে না। বরং সে দুর্বলতা, পাপ ও পাপের গোলামি থেকে রবের রহমতের দিকে পলায়ন করবে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয় তিনি তাঁর দিকে প্রত্যাবর্তনকারীদের প্রতি অধিক ক্ষমাশীল।’ (সুরা ইসরা: ২৫)
আল্লাহ তায়ালা আমাদের প্রতি করুণা করেছেন, তাই তিনি যারা পাপরাশিতে ও উদাসীনতায় নিমজ্জিত তাদের সঙ্গেও সুসম্পর্ক বজায় রাখেন, তাঁর দিকে ডাকেন, তাদের জন্য ক্ষমার দরজা উম্মুক্ত রাখেন এবং তাদেরকে ক্ষমার সুসংবাদের প্রতি অত্যন্ত নরম সুরে আহ্বান করেন। তিনি বলেছেন, ‘বলুন, হে আমার বান্দাগণ! তোমরা যারা নিজেদের প্রতি অবিচার করেছ; আল্লাহর অনুগ্রহ থেকে হতাশ হয়ো না, নিশ্চয় আল্লাহ সমস্ত গোনাহ ক্ষমা করবেন। নিশ্চয় তিনি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।’ (সুরা জুমার: ৫৩)
ইস্তেগফার তাওবার একটি অবশ্যকীয় বিষয় ও তার প্রবেশদ্বার। ইস্তেগফারের বিরাট মর্যাদা রয়েছে। ইস্তেগফারকারীর বিভিন্ন অবস্থা রয়েছে। আদি পিতামাতা আদম ও হাওয়া (আ.)-এর ইস্তেগফার ছিল পাপের স্বীকারোক্তি এবং আসমান ও জমিনের রবের প্রতি লজ্জাশীলতার প্রকাশ। ‘হে আমাদের রব! আমরা নিজেদের প্রতি জুলুম করেছি। আর যদি আপনি আমাদেরকে ক্ষমা না করেন এবং দয়া না করেন, তবে অবশ্যই আমরা ক্ষমাগ্রস্তদের অন্তভুক্ত হব।’ (সুরা আরাফ: ২৩)
দুই ভাই মুসা ও হারুন (আ.)-এর ইস্তেগফার ছিল সম্পর্ক রক্ষা এবং বিশ্বজগতের প্রতিপালকের বার্তা পৌঁছে দেয়ার ক্ষেত্রে সত্যবাদিতার সাক্ষ্য স্বরূপ। মুসা বললেন, হে আমার রব! আমাকে ও আমার ভাইকে ক্ষমা করুন এবং আমাদেরকে আপনার রহমতের মধ্যে প্রবিষ্ট করান। আর আপনিই শ্রেষ্ঠ দয়ালু।’ (সুরা আরাফ: ১৫১)
আর আল্লাহর দুজন খলিলের ইস্তেগফার ছিল অনুগ্রহ ও দয়ার স্বীকারোক্তি: ‘হে আমার রব! আমাকে সালাত কায়েমকারী করুন এবং আমার বংশধরদের মধ্য হতেও। হে আমাদের রব! আর আমার দোয়া কবুল করুন। হে আমাদের রব, যেদিন হিসাব অনুষ্ঠিত হবে সেদিন আমাকে, আমার পিতা-মাতাকে এবং মুমিনদের ক্ষমা করুন।’ (সুরা ইবরাহিম: ৪০-৪১)
তিনি তাঁর সবচেয়ে বড় অন্তরঙ্গ বন্ধু নবী (সা.)-কে বলেছেন, ‘কাজেই জেনে রাখুন যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো সত্য ইলাহ নেই। আর ক্ষমা প্রার্থনা করুন আপনার ও মুমিন নর-নারীদের ত্রুটির জন্য। আল্লাহ তোমাদের গতিবিধি এবং অবস্থান সম্পর্কে অবগত রয়েছেন।’
যখন রাসুল (সা.) আবু বকর সিদ্দিক (রা.)-এর কন্যা আয়েশা (রা.)-এর জন্য ইস্তেগফার করেছিলেন, তখন তিনি বলেছিলেন, ‘হে আল্লাহ! আপনি আয়েশার পূর্বের ও পরের এবং প্রকাশ্য ও গোপন গোনাহসমূহ ক্ষমা করে দিন।’ এ ইস্তেগফার শুনে যখন আয়েশা (রা.) আনন্দিত হলেন তখন তিনি বললেন, ‘প্রত্যেক সালাতে এটি আমার উম্মতের জন্য আমার দোয়া।’
সুতরাং আমাদের প্রত্যেকের জন্যই রাসুল (সা.) ইস্তেগফার তথা ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন। মহান আল্লাহ বলেন, ‘যখন তারা নিজেদের প্রতি জুলুম করে তখন তারা আপনার কাছে আসলে ও আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করলে এবং রাসুলও তাদের জন্য ক্ষমা চাইলে তারা অবশ্যই আল্লাহকে পরম ক্ষমাশীল ও পরম দয়ালুরূপে পাবে।’ (সুরা আন-নিসা: ৬৪)
ইস্তেগফার আসমান হতে বারি বর্ষিত হওয়াকে সহজ করে; ধন-সম্পদে সমৃদ্ধ করে; উত্তম সামগ্রী এবং শরীরে শক্তির উৎস জোগায় এবং এটা পরম দয়ালু ও অতি স্নেহময়ের ভালোবাসা লাভের মাধ্যম। মহান আল্লাহ বলেন, ‘অতঃপর বলেছি, তোমাদের রবের নিকট ক্ষমা প্রার্থনা কর, নিশ্চয় তিনি ক্ষমাশীল। তিনি তোমাদের জন্য প্রচুর বৃষ্টিপাত করবেন। এবং তিনি তোমাদেরকে সমৃদ্ধ করবেন ধন-সম্পদে ও সন্তান-সন্ততিতে এবং তোমাদের জন্য স্থাপন করবেন উদ্যান ও প্রবাহিত করবেন নদী-নালা।’ (সুরা নুহ: ১০-১২)
‘আর আপনারা আপনাদের রবের নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করুন অতঃপর তার নিকট তাওবা করুন..।’
ইস্তেগফার হলো মুমিনদের সঙ্গে ফেরেশতাগণের সম্পর্কের সেতুবন্ধন। মহান আল্লাহ বলেন, ‘যারা আরশ ধারণ করে আছে এবং যারা এর চারপাশে আছে, তারা তাদের রবের পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে প্রশংসার সঙ্গে এবং তার ওপর ঈমান রাখে, আর মুমিনদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে বলে, হে আমাদের রব! আপনি দয়া ও জ্ঞান দ্বারা সবকিছুকে পরিব্যাপ্ত করে রেখেছেন। অতএব যারা তাওবা করে এবং আপনার পথ অবলম্বন করে আপনি তাদেরকে ক্ষমা করুন। আর জাহান্নামের শাস্তি থেকে আপনি তাদের রক্ষা করুন। হে আমাদের রব! আর আপনি তাদেরকে প্রবেশ করান স্থায়ী জান্নাতে যার প্রতিশ্রুতি আপনি তাদেরকে দিয়েছেন এবং তাদের পিতামাতা, পতি-পত্নী ও সন্তান-সন্ততিদের মধ্যে যারা সৎকাজ করবে তাদেরকেও। নিশ্চয়ই আপনি পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়। আর আপনি তাদেরকে অপরাধের শাস্তি থেকে রক্ষা করুন। সেদিন আপনি যাকে (অপরাধের) খারাপ পরিণতি থেকে রক্ষা করবেন, তাকে অবশ্যই অনুগ্রহ করবেন; আর এটাই মহাসাফল্য!’ (সুরা গাফির: ৭-৯)
আর ইস্তেগফার তো প্রতিপালক মা’বুদের প্রতি অবিশ্বাস ও অকৃজ্ঞতার ন্যায় অপরাধের সরল স্বীকারোক্তি এবং বিশ্বপালনকর্তা আল্লাহর ইবাদতের হক আদায়ে অপারগতা অবলোকন করার নাম।
সুতরাং যে ব্যক্তি এ স্বীকারোক্তির ময়দানে তাঁর পবিত্রতা ঘোষণা করবে সে হবে তাসবিহ পাঠকারী, যে তাঁর মহত্ব বর্ণনা করবে সে হবে তাকবির পাঠকারী, আর যে তাঁর গুণকীর্তন করবে সে হবে হাম্দ তথা প্রশংসাকারী আর যে তাঁর একত্বের ঘোষণা করবে সে হবে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ পাঠকারী। এ জন্য যে ব্যক্তি তাসবিহ, তাহমিদ এবং তাকবির তেত্রিশবার করে পাঠ করবে এবং একশতবার পূর্ণ করতে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহু লা শারিকা লাহু, লাহুল মুলকু ওয়া লাহুল হামদু, ওয়া হুয়া আলা কুল্লি শাইয়িন কাদির’ দোয়াটি পড়বে; তার সকল গোনাহ মাফ করে দেয়া হবে, যদিও তা সাগরের ফেনা সমপরিমাণ হয়।
আর যে ব্যক্তি সালাত আদায়কারী হয়, বস্তুত সে ইস্তেগফারকারী হয়। আল্লাহ বলেন, ‘তারা রাতের অল্পই শয্যা গ্রহণ করত, আর শেষ রাতে তারা ক্ষমা প্রার্থনা করত।’ অর্থাৎ— সালাত আদায় করত।
রুকুর বিনম্রতার মাঝে ইস্তেগফার রয়েছে— ‘হে আল্লাহ, আমাদের প্রতিপালক! আমরা আপনার সপ্রশংসা, পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করছি। হে আল্লাহ! আমাকে ক্ষমা কর।’
সিজদার বিনয়ের মাঝে ইস্তেগফার রয়েছে— ‘হে রব! আমার সকল প্রকার গোনাহ ক্ষমা করে দিন; কম এবং বেশি, প্রথম এবং শেষ, প্রকাশ্য এবং গোপনীয়।’
দুই সিজদার মধ্যবর্তী স্থানে রয়েছে বন্দি ও অসহায়ের ন্যায় ইস্তেগফার— ‘হে রব! আমাকে ক্ষমা করুন। হে রব! আমাকে ক্ষমা করুন। হে রব! আমাকে ক্ষমা করুন।’
সত্যসহ যিনি এসেছেন তিনি আবু বকর সিদ্দিক (রা.) (যিনি তাকে সত্য নবী হিসেবে স্বীকার করে নিয়েছিলেন) কে সালাতে পাঠের জন্য এই দোয়া শিক্ষা দিয়েছিলেন— ‘হে আল্লাহ! আমি আমার নিজের ওপর অনেক জুলুম করেছি। আপনি ছাড়া আমার গোনাহ মাফ করার আর কেউ নেই। আপনার পক্ষ থেকে আমাকে ক্ষমা করে দিন এবং আমার ওপর রহমত বর্ষণ করুন। নিশ্চয় আপনি ক্ষমাশীল ও দয়াবান।’
সালাতের শেষেও ইস্তেগফার রয়েছে। আর সাওম হলো ধৈর্যশীলদের ও বিশ্বপালনকর্তার পক্ষ থেকে সাহায্য প্রার্থীদের ইস্তেগফার। ‘আর তোমরা ধৈর্য ও সালাতের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা কর। আর নিশ্চয় তা বিনয়ীরা ছাড়া অন্যদের ওপর কঠিন।’
রমজান, আরাফা, আশুরা এবং অন্যান্য দিনের সাওমের সঙ্গেও মাগফিরাতের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। আর মজলিসের কাফফারার দোয়া যার মাধ্যমে মজলিসের ভুল-ত্রুটি মাফ করা হয় তা হলো— ‘সুবহানাকা আল্লাহুম্মা ওয়াবি হামদিকা, আশহাদু আল্লা ইলাহা ইল্লাহ আনতা, আস্তাগফিরুকা ওয়া আতূবু ইলাইকা।’
রহমাতুল্লিল আলামিন নবী (সা.) তাঁর বৈঠকগুলোতে প্রকাশ্যে ইস্তেগফার পাঠ করতেন। ইবনে উমর (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘একই মজলিসে বসে আমরা নবী (সা.)-এর এই ইস্তেগফারটি একশবার পর্যন্ত পাঠ করতে গুনতাম: হে আমার প্রতিপালক! আমাকে ক্ষমা কর, আমার তাওবা কবুল কর, নিশ্চয় তুমি অতিশয় তাওবা কবুলকারী, দয়াবান।’
১৯ রজব ১৪৪৪ হিজরি (১০ ফেব্রুয়ারি ২০২৩) মদিনার মসজিদে নববিতে প্রদত্ত জুমার খুতবার অনুবাদ
নয়া শতাব্দী/আরআর
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ