নয়া শতাব্দী অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি।
দুনিয়াপাগল একটি মধ্যবিত্ত পরিবার আমাদের। পরিবারের সব কিছু আধুনিক সমাজের রীতি অনুযায়ী সম্পন্ন হয়ে থাকে। দুই ভাইয়ের পর মা-বাবার তৃতীয় সন্তান আমি। বোনদের ভেতর সবার বড়। বিশ্ববিদ্যালয়ে বিএ অনার্সে পড়ালেখা চলছে আমার। সঙ্গে স্থানীয় একটি প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করি। পড়াশোনা ও চাকরির পাশাপাশি সন্ধ্যার পর বাড়িতে স্কুলের বাচ্চাদের কোচিং করাই। কোচিংয়ে অধিকাংশ ছিল ক্লাস টেনের ছাত্র। প্রাথমিকেরও কিছু ছাত্র ছিল। দুনিয়াতে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার খুব আগ্রহ নিয়ে সব কিছু করছিলাম। খাওয়া-ঘুমের কোনো রুটিন ছিল না। আমি ছিলাম বংশের সবচেয়ে আল্ট্রা-মডার্ন ও উচ্চশিক্ষিত নারী। বিশ্ববিদ্যালয়, চাকরির সুবাদে ও আধুনিক ফ্যাশনপাগল হওয়ার কারণে সব সময় বাইরে ঘোরাঘুরি করতাম। পুরুষ বন্ধুদের সঙ্গে দল বেঁধে আড্ডাবাজি, শপিং, মার্কেটে কেনাকাটা করা ছিল নিয়মিত অভ্যাস। এসবকে কখনই অন্যায় বা পাপ মনে হতো না।
মোটকথা, ইসলামের দৃষ্টিতে যেসব ভয়াবহ গুনাহ-অন্যায় আজকালের তরুণী-নারীদের মাঝে দেখা যায়, আমার ভেতর তার সবই ছিল। পারিবারিক যে কোনো অনুষ্ঠানে নিজেকে সবচেয়ে বেশি আকর্ষণীয় করতে চেষ্টার কোনো ত্রুটি করতাম না। আমার সাজ-পোশাক দেখে সবাই জিজ্ঞাসা করত, এই পোশাক কোথা থেকে কালেকশন করেছ? এই জুয়েলারি কোন শপ থেকে কেনা? অশ্লীলতা ও বেহায়াপনার সব বৈশিষ্ট্য আমার ভেতর ছিল। যদিও বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো ছেলের সঙ্গে আমার অবৈধ ভালোবাসার সম্পর্ক ছিল না, কিন্তু ক্যাম্পাসের যে কোনো সুদর্শন ছেলে দেখলে তার সঙ্গে বন্ধুত্ব করার চেষ্টা করতাম। সোজা কথায় চোখ ও মুখের জিনা করতাম! কথিত ধুরন্ধর নারীবাদীদের মতো আমিও সহশিক্ষার পাপমিশ্রিত পদ্ধতির কট্টর সাপোর্টার ছিলাম। নারীদের ঘরের বাইরে পুরুষদের সঙ্গে মিশে কাজকর্ম করাকে আমিও নারী স্বাধীনতা ও আত্মনির্ভরশীলতা মনে করতাম!
এভাবেই আমার দিন অতিবাহিত হচ্ছিল। কিন্তু ভেতর ভেতর আমার এক প্রকার অস্বস্তি ও পেরেশানি লেগে থাকত। কখনও নিজে নিজে ভাবতাম, বিশ্ববিদ্যালয়, চাকরি, কোচিং, নিজের পড়া—এভাবেই একটা চক্করের ভেতর আমার জীবন কাটতে থাকবে? তাহলে আমার জীবনে কি শান্তি ও স্বস্তি বলে কোনো জিনিস নেই? ফলে আকাঙ্ক্ষার চাপে মাঝে মাঝে জীবন থেকে ছুটি নিতে চাইতাম!
বিশ্ববিদ্যালয় ও অফিসে পর্দা করতাম না। শরয়ি পর্দা কাকে বলে বুঝতাম না। তবে নামাজ-রোজা পালনে প্রশান্তি মেলে, এই অনুভূতি ছিল। নাফরমানি থেকে হেদায়েতের পথে আসার ঘটনাক্রম ছিল এমন, এই বিশ্বাস সব সময় ছিল, আল্লাহ তাআলা সাহায্য করলে সমস্ত পাপাচার থেকে ফিরে আসা সম্ভব। আমার অফিসের অধিকাংশ কর্মকর্তা ধার্মিক ছিলেন। শরিয়তের বিধিবিধান পালনে সচেষ্ট ছিলেন। তারা দেশের সুনামধন্য, প্রাজ্ঞ ও বুজুর্গ আলেমদের সঙ্গে ইসলাহি সম্পর্ক রাখতেন। আলেমদের ওয়াজ-নসিহত অনুষ্ঠানে যাতায়াত করতেন। একসঙ্গে অফিস করার কারণে আমার জীবনেও তাদের প্রভাব পড়তে লাগল। একটু একটু করে সহকর্মীদের কথাবার্তা আমার ভিতরে বেশ পরিবর্তন করে ফেলল।
একদিন অফিসে একজন আলেম ফোন করে আমাদের মালিকের সঙ্গে কথা বলতে চাইলেন। উলামায়ে কেরামের একটি ইসলাহি মজলিসে মালিককে দাওয়াত দেবেন। মালিককে না পেয়ে আমাকে দাওয়াত দিলেন। নামাজ ইত্যাদির ব্যাপারে খোঁজ নিলেন। নারী হওয়ায় বিশেষভাবে আমাকে শরয়ি পর্দা সম্পর্কে কিছু নসিহত করলেন। তার কথাগুলো এত সুন্দর ছিল, এমন কোমল ও দরদি ছিল, আমার হৃদয়ে গেঁথে গেল। জীবন পরিবর্তনের বড় টনিক হিসেবে কাজ করল।
ফোনের অপর প্রান্তের ব্যক্তি পুরুষ হওয়ায় তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করা সম্ভব নয়। ফোনে তিনিও বেশি কথা বলেননি। কিন্তু আমার ভেতর যা কাজ করার দরকার সেটা হয়ে গেল! বাড়িতে এসে উলামায়ে কেরামের মজলিসে যাওয়ার জন্য সবাইকে প্রস্তুত করতে লাগলাম। কিন্তু পরিবারের সবাই একটি নির্দিষ্ট ঘরানার মুরিদ হওয়ায় দেওবন্দি উলামায়ে কেরামের মজলিসে উপস্থিত হতে ইচ্ছুক ছিলেন না। উল্টো রাগারাগি করতে লাগলেন। কিন্তু আমি কাউকে না জানিয়ে নারীদের উদ্দেশে উলামায়ে কেরামের বয়ানের একটি মজলিসে নিয়মিত উপস্থিত হতে লাগলাম।
সমস্যা হলো, এই মজলিসে শরিক হওয়ার শর্ত হলো, নিজের ভাই বা মা-বাবার সঙ্গে আসতে হবে। আমি কোনোভাবে আম্মুকে রাজি করিয়ে উপস্থিত হতে লাগলাম। এর কিছুদিন পর আল্লাহ তাআলার অশেষ রহমতে পূর্ণাঙ্গ শরয়ি পর্দা পালন শুরু করলাম। আমার শরয়ি পর্দা পালন দেখে বাড়িতে তুফান বয়ে গেল! উলামায়ে কেরামের মজলিসে যাতায়াতকে তারা মেনে নিতে পারছিলেন না। এক পর্যায়ে চাকরি ছেড়ে দিলাম। অথচ আগে চাকরি ছাড়ার কথা আমার কল্পনারও বাইরে ছিল!
অফিসের বস আমার বেতন বৃদ্ধি করে কর্মঘণ্টা কমিয়ে দিতে চাইলেন। আমি কোনো প্রস্তাবে রাজি হলাম না। বাড়ির কোচিং সেন্টারে যেসব প্রাপ্তবয়স্ক ছাত্র পড়াতাম, তাদের পড়ানো বাদ দিলাম। দুলাভাই, চাচাতো-মামাতো প্রমুখ ভাইদের সঙ্গেও পরিপূর্ণ পর্দা শুরু করলাম। কুদৃষ্টি, পর্দাহীনতা ও নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশার ক্ষতি সম্পর্কে উলামায়ে কেরামের বয়ান শোনার পর আমার অন্তরচক্ষু খুলে গেল। আগের পরিচিত অফিস সহকারীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে কয়েকজন আলেমের সঙ্গে পরামর্শ করলাম।
তারা নির্দিষ্ট কোনো বিজ্ঞ আলেমের নির্দেশনা অনুযায়ী জীবন পরিচালনার আদেশ দিলেন। কিন্তু এই মুহূর্তে আমার পক্ষে সেটা সম্ভব নয়। ফলে তাদের ধর্মীয় কিতাবাদি পাঠের আগ্রহের কথা জানালাম। তারা আমাকে শাইখুল হাদিস মাওলানা জাকারিয়া কান্ধলবি, মাওলানা হাকিম মুহাম্মদ আখতার, মুফতি তাকি উসমানি, মাওলানা আব্দুর রউফ সাখরবি, পীর জুলফিকার আহমদ প্রমুখের কিতাবাদি অধ্যয়নের প্রতি গুরুত্ব দিলেন। এসব কিতাব পাঠে আমার জীবনে যে পরিবর্তন এসেছে, জীবনের পরতে-পরতে যে শান্তি-সুখ ও স্থিতি-তৃপ্তি আমি অনুভব করছি, আগে তা কখনই ছিল না।
ডেইলি ইসলাম-এর সাপ্লিমেন্ট থেকে অনুবাদ আমিরুল ইসলাম লুকমান
নয়া শতাব্দী/আরআর
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ