শনিবার, ০১ এপ্রিল ২০২৩, ১৮ চৈত্র ১৪২৯

অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে ইসলামের প্রেরণা

প্রকাশনার সময়: ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০৯:২৫
ছবি : সংগৃহীত

ইসলাম কর্মে উৎসাহ দেয়। অপছন্দ করে আলস্য ও অক্ষমতা। আর মর্যাদার দিক দিয়ে সবচে’ বড় ও সর্বশ্রেষ্ঠ কাজ সেটি যা আল্লাহর নৈকট্যশীল বানায়। যেমন— নিরেট ইবাদত যথা- সালাত। এবং সেসব বৈধ কাজ যা সৎ নিয়তে সম্পাদিত হয়। যেমন— শিল্প ও কৃষিকাজ।

উপার্জন ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডেণ্ডর মধ্যে ইসলাম শ্রমেই বেশি উৎসাহ দেয়। শ্রমিকের উপার্জনে দেয়া হয় বরকত। চেষ্টা ও হালাল উপার্জনের প্রশংসায় আল্লাহপাক বলেন— ‘অতপর যখন সালাত সমাপ্ত হবে তখন তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড় আর আল্লাহর অনুগ্রহ হতে অনুসন্ধান কর।’ (সুরা জুমুআ’: ১০) আরো এরশাদ হয়েছে— ‘তিনিই তো তোমাদের জন্য জমিনকে সুগম করে দিয়েছেন, কাজেই তোমরা এর পথে—প্রান্তরে বিচরণ কর এবং তাঁর রিজিক থেকে তোমরা আহার কর আর তাঁর নিকটই পুনরুত্থান।’ (সুরা মুলক: ১৫)

হাদিসে এসেছে, ‘মানুষ সহস্তে উপার্জিত রুজির চেয়ে উত্তম কিছু ভক্ষণ করে না।’ (বুখারি: ১৯৩৫) অপর এক হাদিসে এসেছে— ‘যে ব্যক্তি হালাল উপার্জন করতে গিয়ে পরিশ্রান্ত হয়ে রাত্রি যাপন করে সে ক্ষমা প্রাপ্ত হয়েই রাত কাটায়।’

আর কর্মে এবং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে ব্যাপকভাবে। বিশেষ ধরনের কোনো কাজে নয়; যে কোনো কাজে। শর্ত শুধু শরিয়তের দৃষ্টিতে তা হালাল হতে হবে। এ উৎসাহের আওতায় রয়েছে হালাল উপার্জনের সম্ভাব্য সকল কর্মকাণ্ড এবং সব রকম লেনদেন।

যেমন— ব্যবসায় বাণিজ্য, শিল্প, যৌথ কারবার, মুদারাবা, ইজারা এবং সব ধরনের কাজ ও তৎপরতা যা মানুষ হালাল উপার্জনের জন্য অবলম্বন করে থাকে। ইসলামের দৃষ্টিতে কোনো হালাল কাজ করলেই মানুষের মর্যাদা কমে না; লোকে সেটাকে যতই তুচ্ছ জানুক না কেন।

কোরআনের বক্তব্যের আলোকে মানুষের মূল্য ও শ্রেষ্ঠত্বের মানদণ্ড তাকওয়াহ ও দীনদারি। তার সম্পদ ও প্রাচুর্য কিংবা পেশা ও কর্ম নয়। এজন্য আমরা এ উম্মতের মহান পূর্বসূরি আলেম, ফকিহ ও বুজুর্গদের দেখতে পাই তারা কোনো কোনো কাজে নির্দিষ্ট পারিশ্রমিকের বিনিময়ে শ্রম দিয়েছেন।

ইসলাম পরোক্ষভাবে কর্ম ও উপার্জনের প্রতি উদ্বুদ্ধ করার আরেকটি পদ্ধতি অবলম্বন করেছে। তা হলো, দরিদ্রকে সাহায্য করতে উৎসাহিত করেছে এবং সাহায্যকারী ব্যক্তিকে নেকি লাভের দিক দিয়ে সাহায্য গ্রহীতার চেয়ে শ্রেষ্ঠ আখ্যায়িত করেছে। হাদিসে এসেছে— ‘উঁচু হাত নিচু হাতের চেয়ে উত্তম।’ (বুখারি: ১৩৩৮, মুসলিম: ১৭১৫) তেমনি জাকাত, হজ ও বিভিন্ন ইবাদত এবং আল্লাহর পথে ব্যয়ের বড় নেকি রাখা হয়েছে।

এসব নেকি অর্জন সম্ভব নয় হজ ও জাকাতের উপকরণ অর্জন ছাড়া। আর উপকরণ সংগ্রহ করা যাবে না অর্থ-সম্পদ ছাড়া। এদিকে সম্পদ আহরণ ও জীবিকা উপার্জনের মূল হলো শ্রম ও চেষ্টা ব্যয়।

তাই বলা যায়, কর্ম নেকি অর্জনের মাধ্যম কেননা কর্মই অর্থ লাভের উপায়। আর অর্থ ব্যয় আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন এবং পুণ্য লাভের মাধ্যম। এ কারণেই হাদিস শরিফে এসেছে- ‘কতইনা চমৎকার সৎ লোকের পবিত্র সম্পদ।’ (শুআবুল ইমান: ১২৪১) কারণ নেককার ব্যক্তি তার বৈধ সম্পদ আল্লাহর পছন্দনীয় পথে ব্যয় করে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভে ধন্য হয়।

উপযুক্ত কাজ বাছাইয়ের দায়িত্ব ইসলাম ছেড়ে দিয়েছে ব্যক্তির ওপর। ব্যক্তিকে কর্ম বাছাই বা কাজ পছন্দের স্বাধীনতা দিয়েছে। অবারিত করেছে তার জন্য অর্থনৈতিক স্বাধীনতা। সুতরাং তার অধিকার রয়েছে সে যে কাজ ইচ্ছে পছন্দ করবে। এ ব্যাপারে তাকে বাধা দেয়া যাবে না। কিংবা বাধ্যও করা যাবে না। শরিয়তের কোনো উদ্ধৃতিই অর্থনৈতিক স্বাধীনতা বা ব্যক্তির কাজ বাছাইয়ের স্বাধীনতাকে অস্বীকার করে না।

এ বিষয়টির ব্যাখ্যা নির্ভর করবে মানবপ্রকৃতি এবং তার সম্মান ও ব্যক্তিত্ববোধ, তার সম্পদ ব্যক্তিগত কার্যভার বা দায়িত্ব ও সবার কল্যাণের প্রতি মনযোগের ওপর। এর ব্যাখ্যা হলো, জন্মগতভাবে প্রত্যেক মানুষের স্বভাবেই গমন-প্রস্থান এবং গ্রহণ-বর্জনের ক্ষেত্রে স্বাধীনতার প্রতি ঝোঁক রয়েছে। তাই এ সুস্থ স্বভাবজাত টানকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করা ঠিক হবে না। একটা অবলা প্রাণীও তো তার স্বভাবে স্বাধীনতার প্রতি এমন টান উপলব্ধি করে।

হ্যাঁ, এই স্বভাব কখনো বেয়াড়া-বিকৃত হয়ে পড়ে। মানুষ তখন অনিষ্ট ও ক্ষতিকর এবং অক্ষম জিনিস গ্রহণ করে যা হারাম; হালাল নয়। তখন জরুরি হয়ে পড়ে তা ঠিক করে দেয়া এবং স্বাধীনতার রাশ টেনে ধরা। যেন তার স্বাধীনতা হারামের চোরাগলি ত্যাগ করে হালালের সুবিস্তৃত প্রাঙ্গণে ফিরে আসে।

এ ছাড়া কর্মের স্বাধীনতাকে স্বীকৃতি দানের মাঝে মানুষের সম্মান ও শ্রেষ্ঠত্ব রক্ষার উদ্দেশ্যেও নিহিত রয়েছে। কারণ মানুষ স্বভাব-স্বাধীন। স্বাধীন ইচ্ছার অধিকারী সে। তার স্বাধীনতা অন্যান্য প্রাণীদের চেয়ে ভিন্ন। তাকে অন্যসব প্রাণীর সমান করা যাবে না- যাদেরকে পরিচালক যে দিকে চালায় সেদিকেই চলে। অতএব মানুষের স্বাধীনতাকে বিঘ্নিত করা যাবে না। কর্ম ও উপার্জনের ব্যাপারেও অপ্রয়োজনে তার হাত যা চায় তা আহরণ থেকে বাধা দেয়া যাবে না। কারণ এ নগ্ন হস্তক্ষেপ তার শ্রেষ্ঠত্ব চেতনার পরিপন্থী।

এ দিকটি কিন্তু আমাদের ফিকহ বিশারদগণও আমলে নিয়েছেন। এমনকি ইমাম আবু হানিফা (রহ.) অর্বাচীন ভেদ-বুদ্ধিহীন আনাড়িকে ঘরে বন্দি রাখা অবৈধ বলেছেন। তাঁর যুক্তি, এতে করে মানুষ হিসেবে তার যে শ্রেষ্ঠত্ব তার অবমাননা করা হয়। আর মানবিক শ্রেষ্ঠত্ব কেড়ে নেয়া তার সম্পদ ধ্বংসের চেয়েও বড় ক্ষতি।

এখানে এমন যুক্তি দেখানো সঙ্গত হবে না যে, ব্যক্তি স্বাধীনতাকে ক্ষুণ্ন করে রাষ্ট্রের কাঁধে সবার কর্ম নির্ধারণের দায়িত্ব অর্পণ করাই ব্যক্তি ও সমষ্টির জন্য কল্যাণকর। কারণ মানুষের শুধু রুটি-ভাতই প্রয়োজন নয় যা সে গোগ্রাসে গিলবে আর উদর পুর্তি করবে। বরং তার জন্য স্বাধীনতার কোমল বাতাসও দরকার যা দিয়ে সে আত্মা ও অনুভূতি এবং মানবিক উপলব্ধিকে পূর্ণতা ও প্রশান্তি দিবে। এ জন্যই মানুষের কর্মের স্বাধীনতার বিষয়টি স্থির করা জরুরি। মানুষের কাজের পূর্ণ স্বাধীনতা এটাই আসল আর স্বাধীনতাকে শর্তযুক্ত বা খর্ব করাটা ব্যতিক্রম।

কর্মের স্বাধীনতা দানের মধ্যে তেমনি এ উদ্দেশও রয়েছে যে এর দ্বারা মানুষের প্রতিভা এবং তার যোগ্যতা ও সামর্থ্য বৃদ্ধি পায়। কারণ প্রতিটি মানুষ তার রুচি ও প্রকৃতির সঙ্গে মিল রেখেই কর্ম বাছাই করে। ঝাঁপিয়ে পড়ে সে কর্মে বিপুল আগ্রহ ও উদ্দীপনার সঙ্গে। ফলে তার সৃজন ও উৎপাদন বৃদ্ধি পায় এবং কাজে বরকত হয়। আর এতে সার্বিকভাবে উপকৃত হয় সমাজ- যেখানে সে বাস করে।

পক্ষান্তরে যদি ব্যক্তি মানুষের কর্মের স্বাধীনতা ছিনিয়ে নেয়া হয়। কর্ম বাছাইয়ের ভার ছেড়ে দেয়া হয় রাষ্ট্রের ওপর তাহলে প্রতিটি ব্যক্তি তার রুচি ও প্রকৃতির সঙ্গে মানানসই কর্ম-পদ খুঁজে পাবে না। এতে অপমৃত্যু ঘটবে তাদের প্রতিভার। হ্রাস পাবে তাদের কর্মোদ্দীপনা। তখন তারা কাজে যোগ দিবে একরকম বাধ্য ও নিরূপায় হয়ে। এতে কাজের রেজাল্ট আসবে কম।

লোপ পাবে তাদের সৃজন-ক্ষমতা। এর বিরূপ প্রভাব পড়বে তাদের এবং সমাজের ওপর। এছাড়া মানুষ আপন দায়িত্বভার ও তার পছন্দ ও অপছন্দ সম্পর্কে পুঙ্খানুপুঙ্খ জিজ্ঞাসিত হবে। তাই কর্ম বাছাইয়ের ক্ষেত্রে তাকে যথেষ্ট স্বাধীনতা দেয়া ইনসাফের দাবি।

আমরা যে কর্মের স্বাধীনতার কথা বললাম তা তো বল্গাহীন নয়। যখন প্রয়োজন পড়বে— এ স্বাধীনতা সমাজের অনিষ্ট ও ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে অথবা এ স্বাধীনতা গ্রহণের আড়ালে সমাজের অনিষ্ট বা অন্য কোনো কুমতলব থাকবে তখন সর্বসাধারণকে ক্ষতির হাত থেকে বাঁচাতে সরকার অবশ্যই ব্যক্তি স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করবে।

এরই ভিত্তিতে ফিকাহবিদরা ব্যবসায়ী সম্প্রদায় যদি নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য অস্বাভাবিকহারে বাড়িয়ে দেয় তাহলে শাসকের জন্য পণ্যের দাম নির্ধারণ করে দেয়া বৈধ বলেছেন। তেমনি ন্যায্য বেতন-ভাতা না পেয়ে কারখানা ও শিল্প-প্রতিষ্ঠানের শ্রমিকরা যদি কাজ বর্জন করে ধর্মঘট করতে থাকে, তাহলে জনস্বার্থে সরকার শ্রমিকদের ন্যায্য ভাতা ও বেতন নির্ধারণ করে দিতে পারেন।

ব্যক্তিকে কর্মের স্বাধীনতা দানের ফল হলো, উত্তম ইসলামি চরিত্রের আওতায় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে স্বাধীন ও সুস্থ প্রতিযোগিতার স্বীকৃতি। সবার জন্য সমান সুযোগ রয়েছে স্ব-স্ব কর্মক্ষেত্রে অন্যকে ছাড়িয়ে যাওয়ার জন্য দ্বিগুণ শ্রম ও প্রচেষ্টা নিয়োগের। তবে শর্ত হলো নৈতিক মূল্যবোধের বাইরে যাওয়া যাবে না।

এ জন্যই স্বাধীন প্রতিযোগিতার নামে ধোঁকা-প্রতারণা, ঝগড়া-ফ্যাসাদ বা দরপতন ঘটানো যাবে না। কাউকে ঠকানো যাবে না। কারণ এটা মানুষের মেধা, যোগ্যতা ও প্রতিভা কম-বেশির অপরিহার্য পরিণতি।

আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন— ‘... আমিই দুনিয়ার জীবনে তাদের মধ্যে তাদের জীবিকা বণ্টন করে দেই এবং তাদের একজনকে অপর জনের ওপর মর্যাদায় উন্নীত করি যাতে একে অপরকে অধিনস্থ হিসেবে গ্রহণ করতে পারে। আর তারা যা সঞ্চয় করে তোমার রবের রহমত তা অপেক্ষা উৎকৃষ্ট।’ (সুরা যুখরুফ: ৩২)

আল্লাহ তায়ালা তাঁর বান্দাদের মাঝে রিজিক তথা দারিদ্র্যতা ও ধনাঢ্যতায় তারতম্য সৃষ্টি করেছেন যেন একে অপরকে জীবিকা উপার্জনের উপায়গুলোতে ব্যবহার বা অনুগত করে সবাই সবার সকল প্রয়োজন পুরা করতে পারে। আর আল্লাহ তায়ালা এই তারতম্য সৃষ্টি করেছেন বিভিন্নভাবে— যা মানুষের পক্ষে আয়ত্ব করা সম্ভব নয়। যেমন— প্রতিভা ও যোগ্যতার মাঝে পার্থক্য।

এ তারতম্য কখনো পুরোপুরিভাবে দূর করা সম্ভব নয়। তবে এটা সম্ভব এবং কাম্য যে দুর্বলকে সবলের পক্ষ থেকে সাহায্য করা হবে— ইসলাম এটাই বলেছে এবং এরই প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। এটাকে কার্যকর করার জন্য গ্রহণ করেছে বিভিন্ন উপায়।

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ