নয়া শতাব্দী অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি।
জাতীয় শিক্ষানীতি হলো একটি দেশের শিক্ষার উন্নয়ন ও প্রশাসনের জন্য নির্দেশিকা এবং কাঠামো যা শিক্ষার লক্ষ্য, উদ্দেশ্য এবং অগ্রাধিকারের রূপরেখা দিয়ে থাকে এবং শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কার ও উন্নতির জন্য একটি রোডম্যাপ প্রদান করে। জাতীয় শিক্ষানীতি শিক্ষার বিভিন্ন দিক তুলে ধরে, যেমন গ্রহণযোগ্যতা, গুণমান, পাঠ্যক্রম, অর্থায়ন এবং অংশীদারিত্ব। এ নীতির লক্ষ্য হলো প্রত্যেকের মানসম্পন্ন শিক্ষার প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করা এবং এ শিক্ষাব্যবস্থা হবে অন্তর্ভুক্তিমূলক, ন্যায়সঙ্গত এবং প্রতিক্রিয়াশীল যা সমাজের পরিবর্তিত চাহিদাকে পূরণ করবে।
বাংলাদেশের জাতীয় শিক্ষানীতি দেশের শিক্ষার উন্নয়নের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য এবং কৌশলের রূপরেখা দেয়। লিঙ্গ, আর্থ-সামাজিক অবস্থা বা ভৌগোলিক অবস্থান নির্বিশেষে সব নাগরিককে মানসম্মত শিক্ষা প্রদান করা এবং সবার জন্য শিক্ষায় ন্যায়সঙ্গত প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করাই এর লক্ষ্য। এ নীতিটি প্রাথমিক শিক্ষার গুরুত্বের ওপর জোর দিয়ে থাকে, এবং সব শিশু যাতে ন্যূনতম ৮ বছর পর্যন্ত শিক্ষা পায় তার ওপর গুরুত্ব দিয়ে থাকে। এমনকি এটি বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল এবং গণিত (স্টেম) শিক্ষার ওপর গুরুত্ব দিয়ে থাকে। একই সঙ্গে মাধ্যমিক এবং উচ্চশিক্ষার একটি শক্তিশালী ব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেয়। এ নীতিটি কারিগরি এবং বৃত্তিমূলক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের গুরুত্বকেও স্বীকৃতি দেয় এবং এ জাতীয় প্রোগ্রামগুলোতে অংশগ্রহণ এবং গুণমান বাড়াতে চায় এবং শিক্ষক প্রশিক্ষণ এবং উন্নয়নের ওপর জোর দেয়।
কিন্তু এ শিক্ষানীতির সঠিক বাস্তবায়ন আসলে কতটুকু হচ্ছে? আমরা একটি শিক্ষানীতির কিছু উপাদান তুলে ধরে এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করব।
শিক্ষায় প্রবেশাধিকার ও অন্তর্ভুক্তিমূলকতা: বাংলাদেশের জাতীয় শিক্ষানীতির মূল লক্ষ্য হলো লিঙ্গ, সামাজিক অবস্থান বা অন্যান্য কারণ নির্বিশেষে সব ব্যক্তির মানসম্পন্ন শিক্ষায় সমান প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করা। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশে শিক্ষায় অংশগ্রহণ উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে, তবে এখনও কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে যেগুলো মোকাবিলা করা দরকার। এখনও অনেক শিশু, বিশেষ করে প্রতিবন্ধী ব্যক্তি, যারা দরিদ্র এবং প্রান্তিক সম্প্রদায়ের, তারা এখনও স্কুলে যাবার সমান সুযোগ পাচ্ছে না। বাংলাদেশে শিক্ষার অন্যতম প্রধান বাধা দারিদ্র্য। অনেক পরিবার তাদের সন্তানদের স্কুলে পাঠানোর সঙ্গে যুক্ত খরচ যেমন ইউনিফর্ম, পাঠ্যপুস্তক এবং স্কুল ফি বহন করতে পারে না। উপরন্তু, দরিদ্র পরিবারের শিশুদের প্রায়ই তাদের পরিবারকে সমর্থন করার জন্য কাজ করতে হয়, যা তাদের স্কুলে যেতে বাধা দেয়। এ ছাড়াও, মেয়েরা শিক্ষার ক্ষেত্রে এখনো কিছু বাধার সম্মুখীন হচ্ছে, যেমন মেয়েদের চেয়ে ছেলেদের শিক্ষাকে অগ্রাধিকার দেয়া, বাল্যবিয়ে এবং মেয়েদের জন্য সুযোগ-সুবিধার অভাব রয়েছে। গ্রামীণ এলাকায় বা প্রত্যন্ত অঞ্চলে বসবাসকারী শিশুরা প্রায়শই শিক্ষায় প্রবেশের ক্ষেত্রে বৃহত্তর চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়, যেমন স্কুলের অভাব, অপর্যাপ্ত পরিকাঠামো, পরিবহন ব্যবস্থা এবং যোগ্য শিক্ষকের অভাব। তারপরও, বাংলাদেশ সরকার শিক্ষার প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করার জন্য উল্লেখযোগ্য প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে যেমন বিনামূল্যে প্রাথমিক শিক্ষা প্রদান, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষার জন্য বৃত্তি প্রদানের পাশাপাশি শিক্ষক প্রশিক্ষণের কর্মসূচি নেয়া হয়েছে।
শিক্ষার এবং শিক্ষকের গুণমান ও পেশাগত উন্নয়ন: শিক্ষকের মান এবং পেশাগত উন্নয়ন বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ উপাদান এবং জাতীয় শিক্ষানীতিতে তা সম্বোধন করা হয়েছে। কিন্তু তারপরও সবচেয়ে প্রধান সমস্যা হলো যোগ্য শিক্ষকের অভাব। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে এবং অনেক শিক্ষকেরই মানসম্মত শিক্ষা কার্যকরভাবে প্রদানের জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ও সহায়তার অভাব রয়েছে এবং ফলস্বরূপ, শিক্ষার্থীরা সফল হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় শিক্ষা পায় না। উপরন্তু, বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা প্রায়ই সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনা এবং সমস্যা সমাধানের পরিবর্তে মুখস্থ করার উপর খুব বেশি জোর দিয়ে থাকে, যদিও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এ শিক্ষাব্যবস্থায় অনেক পরিবর্তন হয়েছে। শিক্ষার প্রতি এ দৃষ্টিভঙ্গি শিক্ষার্থীদের আধুনিক কর্মশক্তির চাহিদার জন্য পর্যাপ্তভাবে প্রস্তুত করে না এবং বিশ্বায়িত অর্থনীতিতে তাদের প্রতিযোগিতা করার ক্ষমতাকে সীমিত করে। এ ছাড়াও পর্যাপ্ত তহবিলসহ সম্পদের অভাব, এবং অবকাঠামো যেমন ভালো মানের শ্রেণিকক্ষ, গবেষণাগার এবং গ্রন্থাগারের অভাব বাংলাদেশের শিক্ষার মানকে প্রভাবিত করে। এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার জন্য, বাংলাদেশ সরকার শিক্ষক প্রশিক্ষণ ও সহায়তায় বিনিয়োগ বৃদ্ধি, নতুন শিক্ষক নিয়োগ ও মূল্যায়ন প্রক্রিয়া বাস্তবায়ন এবং শিক্ষকদের চলমান পেশাগত উন্নয়নকে উৎসাহিত করে এমন কর্মসূচির প্রচারসহ শিক্ষকের মান ও পেশাগত উন্নয়নের জন্য পদক্ষেপ নিয়েছে।
সমাজের প্রয়োজনের সঙ্গে প্রাসঙ্গিকতা: বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা যাতে সমাজের চাহিদার সঙ্গে প্রাসঙ্গিক হয় তা নিশ্চিত করা দেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য। বাংলাদেশের জাতীয় শিক্ষানীতি শিক্ষার গুরুত্বকে স্বীকৃতি দেয় যা সমাজের প্রয়োজনের সঙ্গে প্রাসঙ্গিক এবং শিক্ষার্থীরা যেন দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্বে সফল হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জন করে সে বিষয়ে গুরুত্ব দিয়ে থাকে। বিশেষ করে, শিক্ষার প্রাসঙ্গিকতা নিশ্চিত করার লক্ষ্য হলো এমন একটি শিক্ষাব্যবস্থা তৈরি করা যেখানে শিক্ষার্থীরা স্নাতক পর্যায়ের পড়াশোনা শেষ করে সমাজের বিভিন্ন সেক্টরে অবদান রাখতে পারবে এবং আধুনিক বিশ্বের চাহিদা মেটাতে তাদের প্রয়োজনীয় জ্ঞান এবং দক্ষতা থাকবে। খেয়াল রাখতে হবে, শিক্ষা শুধু একাডেমিক বিষয় নয়, বরং নীতি, মূল্যবোধ এবং সামাজিক দায়বদ্ধতার মতো ক্ষেত্রগুলোতে শিক্ষার অন্তর্ভুক্তি যেন থাকে সেটাও গুরুত্বপূর্ণ।
প্রযুক্তির একীকরণ: শিক্ষা ব্যবস্থায় প্রযুক্তির একীকরণ বাংলাদেশের জাতীয় শিক্ষানীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক এবং শিক্ষার উন্নতির জন্য এটাকে মূল হাতিয়ার হিসেবে দেখা হয়। প্রযুক্তি শিক্ষায় প্রবেশাধিকার বৃদ্ধিতে, শিক্ষার গুণগত মান উন্নত করতে এবং শিক্ষার্থীদের সম্পৃক্ততা এবং শেখার প্রচারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। উদাহরণ স্বরূপ, প্রত্যন্ত অঞ্চলে শিক্ষার্থীদের দূরশিক্ষা প্রদানের জন্য প্রযুক্তি ব্যবহার একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ, যার সুফল আমরা এখন পাচ্ছি। উপরন্তু, উচ্চ-মানের নির্দেশনা প্রদান এবং শিক্ষার্থীদের ফলাফলের উন্নতিতে শিক্ষকদের সহায়তা করার জন্য প্রযুক্তি ব্যবহার গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় প্রযুক্তির একীকরণ গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছে যার মধ্যে রয়েছে অবকাঠামো ও সম্পদের অভাব, গ্রামীণ ও সুবিধাবঞ্চিত এলাকায় প্রযুক্তির সীমিত অ্যাক্সেস এবং প্রশিক্ষিত যোগ্য শিক্ষকের অভাব। এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার জন্য, বাংলাদেশ সরকার স্কুলে ইন্টারনেট অ্যাক্সেস সম্প্রসারণ, শিক্ষাগত প্রযুক্তির ব্যবহার প্রচার এবং শ্রেণিকক্ষে প্রযুক্তির ব্যবহার বিষয়ে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ প্রদানের মতো উদ্যোগের মাধ্যমে শিক্ষায় প্রযুক্তির অ্যাক্সেস উন্নত করার জন্য কাজ করছে।
তহবিল এবং সংস্থান: তহবিল এবং সংস্থানগুলো বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ উপাদান এবং জাতীয় শিক্ষানীতিতে মূল লক্ষ্য হিসেবে সম্বোধন করা হয়েছে। তরপরও বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা তহবিল ও সম্পদের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে শিক্ষায় সীমিত বিনিয়োগ এবং অনেক স্কুলে মানসম্পন্ন শিক্ষা প্রদানের জন্য পাঠ্যপুস্তক, নির্দেশনামূলক উপকরণ এবং প্রযুক্তিসহ প্রয়োজনীয় সংস্থানের অভাব রয়েছে। এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায়, বাংলাদেশ সরকার শিক্ষার জন্য তহবিল বাড়ানোর কথা ভাবছে, যার মধ্যে রয়েছে শিক্ষায় বিনিয়োগ বাড়ানো, স্কুল ও শিক্ষকদের সহায়তার জন্য নতুন তহবিল ব্যবস্থা গঠন এবং শিক্ষায় বেসরকারি খাতের বিনিয়োগকে উৎসাহিত করা।
ক্রমাগত উন্নতি এবং মূল্যায়ন: ক্রমাগত উন্নতি এবং মূল্যায়ন বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ উপাদান এবং জাতীয় শিক্ষানীতিতে তা উল্লেখ করা হয়েছে। তারপরও, বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা এখনও ক্রমাগত উন্নতি ও মূল্যায়নের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। শিক্ষার জন্য একটি বিস্তৃত, ডেটা-চালিত পদ্ধতির অভাব রয়েছে যার মধ্যে রয়েছে শিক্ষার্থীদের শেখার নিয়মিত মূল্যায়ন এবং শিক্ষকের কর্মক্ষমতা, সেইসঙ্গে প্রোগ্রাম এবং নীতির কার্যকারিতার মূল্যায়ন। এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার জন্য, বাংলাদেশ সরকার শিক্ষাব্যবস্থায় ক্রমাগত উন্নতি ও মূল্যায়নের জন্য কিছু কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে নতুন মূল্যায়ন ও মূল্যায়ন প্রক্রিয়া বাস্তবায়ন, শিক্ষায় তথ্য ও প্রযুক্তির ব্যবহার প্রচার করা এবং শিক্ষক ও বিদ্যালয়ের চলমান পেশাগত উন্নয়নে সহায়তা করা।
সবশেষে বাংলাদেশের জাতীয় শিক্ষানীতি দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নতির জন্য একটি বিস্তৃত কাঠামোর রূপরেখা প্রদান করে, শিক্ষায় প্রবেশাধিকার বৃদ্ধিতে সহায়তা করছে, শিক্ষার গুণগত মান উন্নত করা এবং শিক্ষা যে সমাজের প্রয়োজনের সঙ্গে প্রাসঙ্গিক তা নিশ্চিত করার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করে যাচ্ছে। তবুও বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা সীমিত তহবিল এবং সংস্থান, যোগ্য শিক্ষকের ঘাটতি এবং বিশেষ করে গ্রামীণ এবং সুবিধাবঞ্চিত অঞ্চলে প্রযুক্তির অ্যাক্সেসের অভাবসহ উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জগুলোর মুখোমুখি হচ্ছে। আমরা আশা প্রকাশ করছি, বাংলাদেশের জাতীয় শিক্ষানীতির একদিন তার সব লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারবে এবং সবার নিরলস প্রচেষ্টা এবং বিনিয়োগের মাধ্যমে আমরা সবার জন্য মানসম্মত শিক্ষার সুযোগ নিশ্চিত করতে পারব।
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, গণিত বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
নয়া শতাব্দী/জেআই
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ