নয়া শতাব্দী অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি।
বাংলা ভাষা আমাদের প্রাণের ভাষা। বহু রক্তের বিনিময়ে অর্জিত এ ভাষার মর্যাদা আমরা এখনও দিতে পারি নাই। মহান ভাষা আন্দোলনের ৬৭ বছর হতে চলেছে কিন্তু সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন এখনো হয়নি। উপরন্তু দিনকে দিন বাংলা ভাষার প্রতি বাড়ছে রাষ্ট্রিক, সামাজিক ও ব্যক্তিক অবহেলা। দেশের সর্বোচ্চ আদালতে এখনো রায় লেখা হয় ঔপনিবেশিক ভাষা ইংরেজিতে। প্রশাসন থেকে শুরু করে দেশের স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়েও দিন দিন ইংরেজির আধিপত্য বাড়ছে আর বাড়ছে বাংলার প্রতি অবজ্ঞা-ঔদাসীন্য। এ ধারা অব্যাহত থাকলে বাংলা ভাষার অপমৃত্যু দেখতে পাচ্ছেন ভাষাবিদরা। প্রাণের মৃত্যুর মতোই যে কোনো ভাষার স্বাভাবিক মৃত্যু মেনে নেওয়া যায়। কিন্তু ভাষা হত্যা বা ভাষার অপমৃত্যু কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। বাংলা ভাষাকে হত্যার সুদূরপ্রসারী ষড়যন্ত্র পরিলক্ষিত হচ্ছে সর্বত্র।
আর কিছুদিন পরেই একুশে ফেব্রুয়ারি মহান শহিদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। ভাষা শহিদদের স্মরণে নগ্নপায়ে শহিদ মিনারে গিয়ে শ্রদ্ধায় মাথা নত করবে গোটা জাতি। গর্বে বুক ফুলিয়ে বলবে—‘মোদের গরব মোদের আশা আ-মরি বাংলা ভাষা’। শহিদদের স্মরণে গাইবে- ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি’। কিন্তু ফেব্রুয়ারি চলে গেলে সবাই দিব্যি ভুলে যায় বাংলা ভাষার প্রতি নিজেদের অঙ্গীকার ও কর্তব্যের কথা। দৈনন্দিন জীবনে বাংলার পরিবর্তে ইংরেজি বা অন্য ভাষার ব্যবহার এমন মাত্রায় বেড়েছে যে তাতে বাংলা ভাষা নিতান্তই অসহায় হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে ইংরেজি ভাষার আধিপত্য সর্বগ্রাসী রূপ নিয়েছে। ইংরেজিতে বলতে এবং লিখতে অধিকাংশ মানুষই গৌরব ও আভিজাত্য অনুভব করেন। আর ইংরেজি না জানা গ্লানিকর ও লজ্জাকর ভাবেন সবাই। ফলে বাংলা জানা মানুষের মধ্যে তৈরি হচ্ছে হীনমন্যতা আর ইংরেজি শিক্ষার প্রতি তৈরি হচ্ছে প্রবল আগ্রহ। এ থেকেই শুরু বাংলা ভাষার প্রতি অবজ্ঞা ও উদাসীনতা। সে অবজ্ঞা ও উদাসীনতার পথ ধরেই ঢুকে পড়ছে আপন সংস্কৃতিবিধ্বংসী নানা উপাদান। এর ফলে শুধু ভাষার শৃঙ্খলাই নষ্ট হচ্ছে না, নষ্ট হচ্ছে সামাজিক-সাংস্কৃতিক শৃঙ্খলাও।
মাতৃভাষার জন্য বিশ্বের বুকে প্রাণ দেওয়ার নজির রয়েছে কেবল বাঙালি জাতির। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি শহিদের তাজা খুনের বিনিময়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বাংলা ভাষার অধিকার। আর সে জন্য বিশ্ব তার স্বীকৃতিও দিয়েছে। ১৯৯৯ সালে জাতিসংঘ একুশে ফেব্রুয়ারিকে করেছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। এর মধ্যে সারা বিশ্বের শত-সহস্র মাতৃভাষার সম্মান, মর্যাদা এবং আপন মহিমায় বিকশিত হওয়ার প্রেরণা রয়েছে। কিন্তু সারা বিশ্বে সে প্রেরণা ছড়িয়ে দিয়ে নিজেরাই হয়ে পড়ছি উন্মুল ভাষাভাষী। এটা লজ্জার। মূলত বাঙালি জাতির মধ্যে ঔপনিবেশিক মানসিকতার ক্রমবিস্তৃতিই বাংলা ভাষার এমন দুর্গতি টেনে এনেছে বলে মনে করা হচ্ছে।
সাধারণ ও সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ এ দুর্গতির জন্য দায়ী নয়। তাদের হাতে ভাষা বিপদগ্রস্তও হয় না। ভাষা বিপদগ্রস্ত হয় সমাজের উঁচু শ্রেণি, ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকা গোষ্ঠী ও পরজীবী মানসিকতার মানুষের হাতে। তারা সমাজের সর্বত্র আধিপত্য বিস্তার করে আছে। সাধারণ মানুষের থেকে নিজেদের আলাদা প্রতিপন্ন করার জন্য তারা ইংরেজি ভাষাকে বেছে নিয়েছে। ইংরেজি ভাষাকে ‘অভিজাত’ তকমা দিয়েছে। পাশাপাশি ইংরেজি না জানা সমাজের সাধারণ মানুষকে হীনমন্যতায় ভোগার ‘মন্ত্র’ দিয়ে যাচ্ছে। এমন ধারণা প্রতিষ্ঠিত করা হচ্ছে— ইংরেজি না জানলে ভালো চাকরি হবে না, ব্যবসার প্রসার ঘটবে না, ভালো সাহিত্য জানা যাবে না, অভিজাত হওয়া যাবে না ইত্যাদি। প্রচ্ছন্নভাবে এ ধরনের মানসিকতার পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে যাচ্ছে রাষ্ট্রও। কারণ এ দেশেই অভিজাত শ্রেণির জন্য তৈরি করা হয়েছে ইংরেজি মাধ্যমের স্কুল-কলেজ, মাদরাসা ও বিশ্ববিদ্যালয়। ফলে ইংরেজি জানার কারণে সবচেয়ে আকর্ষণীয় চাকরি, ব্যবসা বা অন্যান্য সুযোগ ভোগ করছে এ শ্রেণির লোকজন। এতে বৈষম্যের শিকার হচ্ছে সাধারণ স্কুল-কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। এমন বৈষম্য থেকে রক্ষা পেতে সাধারণ শ্রেণির মানুষের মধ্যেও ইংরেজির প্রতি আগ্রহ তৈরি হচ্ছে এবং পক্ষান্তরে বাংলার প্রতি তৈরি হচ্ছে অবহেলা।
পাশাপাশি যত্ন-আত্তির অভাব ও চরম উদাসীনতার কারণে বাংলা ভাষা বিপদগ্রস্ত হচ্ছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। বিশেষ করে তথ্য-প্রযুক্তির যুগে ভাষার বিকৃত ব্যবহার ও অন্য ভাষার সঙ্গে সংমিশ্রণ বাংলা ভাষার স্বকিয়তা নষ্ট করছে। অথচ সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রভাষা বাংলার সুষ্ঠু ব্যবহার ও মর্যাদা রক্ষার কর্তব্য রয়েছে সরকার ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর। সে ক্ষেত্রে চরম অবহেলার অভিযোগ তুলেছেন ভাষা সংগ্রামীরাই।
সরকারি নথিপত্রে বাংলা ভাষা ব্যবহারে প্রশাসনের পক্ষ থেকে যথেষ্ট উন্নাসিকতা আছে। সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার পাশাপাশি বিদ্যমান আইন ও হাইকোর্টের আলাদা দুটি আদেশ থাকার পরও সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন নিশ্চিত হচ্ছে না। একইসঙ্গে রোধ করা যাচ্ছে না বাংলা ভাষার দূষণ। এমনকি বিভিন্ন নামফলক, বিলবোর্ড, সাইনবোর্ড বাংলায় লেখার প্রজ্ঞাপন থাকলেও তা কেউ মানছে না।
স্বাধীন বাংলাদেশে সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রচলনে আইন করা হয় ১৯৮৭ সালের ৮ মার্চ। ১৯৭৯ সালের ২৪ জানুয়ারি তৎকালীন মন্ত্রিসভা সর্বস্তরে বাংলা ভাষা নিশ্চিত করতে গ্রহণ করে ৯টি সিদ্ধান্ত। সে বছরেরই ১৬ ফেব্রুয়ারি ১০ সচিবের সমন্বয়ে গঠন করা হয় বিশেষ কমিটি। ১৯৮৪ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের আদেশে বলা হয়— ‘রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানরা বারবার সব স্তরে বাংলা প্রচলনের আদেশ দিলেও আংশিক কার্যকরী হয়েছে, কোথাও হয়নি।
১৯৭৮ সালের আইন অনুযায়ী সরকারি অফিস, আদালত, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান বিদেশের সঙ্গে যোগাযোগের প্রয়োজন ছাড়া অন্য যে কোনো নথি ও চিঠিপত্র, আইন-আদালতের সওয়াল-জবাব এবং অন্যান্য আইনানুগ কার্যাবলি বাংলায় লেখা বাধ্যতামূলক করা হয়। এমনকি উল্লিখিত কর্মস্থলে যদি কোনো ব্যক্তি বাংলা ভাষা ছাড়া অন্য কোনো ভাষায় আবেদন বা আপিল করেন, সেটা বেআইনি ও অকার্যকর বলে গণ্য হবে, বলা হয় আইনে। কিন্তু তার কিছুই বাস্তবায়ন নেই কোথাও।
১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ইউনেস্কো ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। তার আগের বছর ১৯৯৮ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি বিচারপতি কাজী ইবাদুল হক এবং বিচারপতি মো. হামিদুল হক সমন্বয়ে উচ্চ আদালতের একটি বেঞ্চ ফৌজদারি মামলায় বাংলায় একটি রায় দেওয়ার পর তা নিয়ে দেশজুড়ে আলোচনা হয়। এরকম কয়েকটি ব্যতিক্রম ঘটনা ছাড়া এখনো ইংরেজিতে রায় লেখা হচ্ছে উচ্চ আদালতে।
২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে হাইকোর্টে আইনজীবী ড. ইউনুস আলী আকন্দের একটি রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ওই বছরের ১৭ ফেব্রুয়ারি বিচারপতি কাজী রেজা-উল হকের নেতৃত্বাধীন বেঞ্চ বাংলা ভাষা প্রচলন আইন ১৯৮৭ অনুযায়ী অফিস-আদালত, গণমাধ্যমসহ সর্বত্র বাংলা ভাষা ব্যবহারের নির্দেশ কেন দেওয়া হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেন। পাশাপাশি দূতাবাস ও বিদেশি প্রতিষ্ঠান ছাড়া দেশের সব সাইনবোর্ড, নামফলক ও গাড়ির নম্বর প্লেট, বিলবোর্ড এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়ার বিজ্ঞাপন বাংলায় লেখা ও প্রচলনের নির্দেশ দেন।
নামফলকে বাংলা ব্যবহার করতে বলেন। আদালতের আদেশের তিন মাস পর ২০১৪ সালের ১৪ মে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সিটি করপোরেশন, পৌরসভা ও ক্যান্টনমেন্ট বোর্ডগুলোকে আদেশটি কার্যকর করতে বলে। কিন্তু সে আদেশের বাস্তবায়নে কোনো উদ্যোগই চোখে পড়েনি কোথাও। ২০১৫ সালের ১৮ আগস্ট আদালত থেকে বলা হয়, বাংলা ব্যবহারে দৃশ্যত কোনো অগ্রগতি নেই। পরে ২০১৬ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়কে এক চিঠির মাধ্যমে সাইনবোর্ড, বিলবোর্ড, ব্যানার, গাড়ির নম্বর প্লেটে বাংলা ভাষার ব্যবহার নিশ্চিত করার অনুরোধ জানায় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।
প্রতি বছর ফেব্রুয়ারি মাস এলে বাঙালি জাতি তার চেতনায় শাণ দেয়। একুশে আমাদের গৌরবোজ্জ্বল অতীতকে মনে করিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি সাবধান বাণীও উচ্চারণ করে। বিশ্বায়নের এ যুগে বাইরের আক্রমণ থেকে বাঁচাতে নিজের ভাষার পরিচর্যায় আরও বেশি যত্নশীল হতে হবে। না হলে ভাষার সংগ্রাম নিয়ে গৌরবোজ্জ্বল অতীতের জাবর কাটতে কাটতে আর নিজের ভাষার প্রতি ঔদাসীন্য দেখাতে দেখাতে একদিন অলক্ষে আমাদের প্রাণের ভাষাটি হারিয়ে যেতে পারে। অনুর্বর হয়ে যেতে পারে জ্ঞান-বিজ্ঞান-সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চার নিজস্ব ক্ষেত্র।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট
নয়া শতাব্দী/জেআই
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ