ঢাকা, মঙ্গলবার, ২৮ মার্চ ২০২৩, ১৪ চৈত্র ১৪২৯, ৫ রমজান ১৪৪৪

পর্যটন বিকাশে নতুন সম্ভাবনা তরুণদের আগ্রহ

প্রকাশনার সময়: ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১১:২২

পর্যটন একটি বহুমুখী শিল্প খাত। এ শিল্পটিরও অনেক শাখা-প্রশাখা বিস্তৃত হয়েছে, যেমন— ঐতিহাসিক নিদর্শন, প্রকৃতি, সংস্কৃতি ও কৃষ্টি, ধর্ম, স্বাস্থ্য, খেলাধুলা, ব্যবসা-বাণিজ্য। পর্যটনশিল্পে বাংলাদেশের রয়েছে অপার সম্ভাবনা। বাংলাদেশকে বিশ্বের দ্রুত বর্ধনশীল ১০টি পর্যটন কেন্দ্রের একটি হিসেবে ভাবা হচ্ছে। পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, পর্যটকরা এখন পুরাকীর্তি, বাংলো, বাগান, পাহাড়, সাগর, ঝরনার পাশাপাশি ইকো ট্যুরিজমের দিকে ঝুঁকছে। প্রকৃতির পাশাপাশি মানুষের বিচিত্র জীবনধারা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের প্রতিও পর্যটকদের আকর্ষণ বাড়ছে। তাই পর্যটন শিল্প বিকাশের অবারিত সুযোগ রয়েছে বাংলাদেশে। আশার খবর হচ্ছে, এখন দেশে ৫০ থেকে ৬০ লাখ মানুষ ঘুরতে যায়। পাঁচ বছর আগে এ সংখ্যা ছিল ২৫ থেকে ৩০ লাখ। ২০০০ সালের দিকে এ সংখ্যা ছিল মাত্র ৩ থেকে ৫ লাখ। বিদেশি পর্যটক নির্ভরতা ছাড়াও দেশীয় পর্যটকদের নিরাপত্তা, যোগাযোগ সুবিধা, আকর্ষণীয় অফার এবং পর্যটন ব্যয় সীমার মধ্যে থাকলে দেশের মানুষ আগ্রহ নিয়ে দেশ ঘুরে দেখতে চাইবে। আর দেশের মানুষকে দেশ দেখানো- স্লোগানে এ সুযোগ কাজে লাগাতে পারলে পর্যটন শিল্পে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে। এক হিসেবে বলা হয়, ১৬ কোটির বেশি মানুষের বাংলাদেশ গড়ে প্রতি বছরে ১০ ভাগও যদি দেশ ঘুরে দেখে তাহলে বিশাল অঙ্কের অর্থনৈতিক তৎপরতা সৃষ্টি হবে।

দেশের অর্থনৈতিক ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের সৌখিনতা ও ভ্রমণবিলাশের প্রবণতা বাড়ছে। এটি খুবই ইতিবাচক একটি দিক। কারণ এখন দেশের মধ্যবিত্ত এমনকি নিম্নবিত্তরাও সময়-সুযোগ পেলেই পরিবার-পরিজন নিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে ঘুরে বেড়াতে পছন্দ করে। ব্যাপক প্রচারের মাধ্যমে পর্যটনের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি ক্ষেত্রে ফেসবুক, ইউটিউবসহ সামাজিক মাধ্যমগুলো বিরাট ভূমিকা রাখছে। বিশেষত ফেসবুকের কল্যাণে ভ্রমণপিপাসু মানুষের বিভিন্ন স্থানে ঘুরে বেড়ানোর ছবি ও ভিডিও ক্লিপগুলো সর্বসাধারণকে ভ্রমণে উৎসাহী করে তুলছে। এছাড়া পর্যটন নিয়ে ব্যাপকভাবে লেখালেখি হচ্ছে। এসবের মাধ্যমে নতুন নতুন পর্যটন কেন্দ্রের আবিষ্কার এবং ভ্রমণে এসব স্থান ব্যাপকভাবে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। বিশেষত পর্যটনে তরুণদের আগ্রহ ইতিবাচক। কেননা দেশ ঘুরে দেখার আগ্রহ বাড়ছে তরুণ-তরুণীদের মধ্যে। পড়াশোনা ও কাজের ফাঁকে এখন গ্রুপভিত্তিক তরুণ-তরুণীরা দেশের বিভিন্ন পর্যটন স্পটে ঘুরে বেড়াচ্ছে। পর্যটনে নারীদের অংশগ্রহণও বাড়ছে। আরেকটি লক্ষণীয় ব্যাপার হচ্ছে, বিগত ১০ বছরে ঈদকে কেন্দ্র করে নাগরিকদের মধ্যে ভ্রমণ প্রবণতা নতুন আশাবাদ জাগাচ্ছে। ঈদের ছুটিকে মানুষ এখন গ্রামের বাড়ি বেড়ানোর পাশাপাশি নিজ এলাকা ও অন্যান্য স্থানেও ঘুরে বেড়াতে পছন্দ করে। পরিসংখ্যান অনুসারে, প্রতি ঈদে প্রায় ২ থেকে ৩ লাখ পর্যটক ভ্রমণ করে কক্সবাজার, যেখানে সারা বছর কক্সবাজার ভ্রমণে যায় ১৫ থেকে ২০ লাখ পর্যটক। ঈদকে কেন্দ্র করে বিশেষ পর্যটন স্থানগুলো ছাড়াও জেলা পর্যায়ে ভ্রমণে বিশেষ প্যাকেজ থাকলে ঈদ পর্যটনের আয় ও জনপ্রিয়তা আরও বাড়বে। আবার লক্ষ করা গেছে, এখনকার তরুণ পর্যটকরা অনেক বেশি রোমাঞ্চপ্রিয়। তরুণদের হাত ধরে শুরু হয়েছে অ্যাডভেঞ্চার ট্যুরিজম। বর্তমান প্রজন্মের তরুণরা কক্সবাজারে সমুদ্রসৈকত, সুন্দরবন অথবা সিলেটের চা-বাগান ভ্রমণে সন্তুষ্ট নন। তারা সুউচ্চ দুর্গম পাহাড়ে উঠে অথবা সমুদ্রের উত্তাল ঢেউয়ের সঙ্গে সার্ফিংয়ের রোমাঞ্চের স্বাদ খোঁজে। সুখবর হলো, এ ধরনের রোমাঞ্চে ঠাসা পর্যটনের অভিজ্ঞতা এখন দেশেই পাওয়া যাচ্ছে। আর এমন রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতার স্বাদ নিতে বান্দরবান, খাগড়াছড়ির দুর্গম পাহাড়ে দল বেঁধে ভ্রমণে যাচ্ছে তরুণ-তরুণীসহ নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ। কক্সবাজারে তৈরি হয়েছে ঢেউয়ের সঙ্গে সার্ফিং করার সুযোগ। সিলেটের সবচেয়ে বড় ও পুরোনো চা-বাগান মালনিছড়ার উঁচু-নিচু টিলায় সাইকেল চালানোর সুযোগ এখন পাওয়া যাচ্ছে। তরুণ-তরুণীদের আগ্রহে দেশে দিন দিনই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে রোমাঞ্চর ভিন্নধর্মী এ ধরনের পর্যটনের। আমাদের পর্যটন শিল্প আরও বিকশিত হতে পারে যেসব মাধ্যমে—

নৌ পর্যটন: বাংলাদেশের নদীগুলোর অবস্থা করুণ হলেও বিশ্বের অনেক দেশেই এমন নদীবিধৌত ভূখণ্ড নেই। তাই আরামদায়ক ও পরিবেশ-প্রকৃতিবান্ধব পর্যটন হিসেবে রিভার ট্যুরিজম বা নৌ পর্যটনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর কথা ভাবা দরকার। আমরা জানি, শহরের অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ ব্যবস্থাকে আরও সুগম করা এবং পর্যটকদের বাড়তি আকর্ষণ সৃষ্টির লক্ষ্যে এশিয়া, ইউরোপ, আফ্রিকা, আমেরিকা এবং মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশে শহরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে নতুন মাত্রা যুক্ত করার জন্য খাল কেটে নদী এবং সাগরের পানি শহরের ভেতর আনা হয়েছে। এর ফলে ভারতের কেরালা, জম্মু কাশ্মির কিংবা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, মালদ্বীপ, শ্রীলঙ্কা ও মরিশাসে নৌ পর্যটন জনপ্রিয়তা পেয়েছে। পরিকল্পিত উপায়ে অগ্রসর হলে নৌ ট্যুরিজম আমাদের জাতীয় অর্থনীতিতে সমৃদ্ধির গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হয়ে উঠতে পারে।

স্কুল ট্যুরিজম : মালয়েশিয়ার আদলে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বছরে একবার ‘স্কুল ট্যুরিজম’ বা শিক্ষা সফর আয়োজন বাধ্যতামূলক করা দরকার। এর ফলে প্রজন্মের সন্তানরা দেশকে চিনবে, জানবে, ভালোবাসবে। পাশাপাশি আয় হবে শতকোটি টাকা। শুধু বিদেশি পর্যটকদের নির্ভরতায় না থেকে ‘দেশকে চিনুন, দেশকে জানুন’; ‘ঘুরে দেখুন বাংলাদেশ-ভালোবাসুন বাংলাদেশ’ এরকম দেশাত্মক স্লোগানে দেশের মানুষকে দেশ দেখানোর লক্ষ্যে ব্যাপক প্রচারণা চালানো দরকার।

হাওরাঞ্চলের পর্যটন: সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান ডব্লিউ মজিনা হাওরকে ‘উড়াল পঙ্খীর দেশ’ হিসেবেও আখ্যায়িত করেছেন। আশার খবর হচ্ছে, হাওরাঞ্চলের আকর্ষণীয় স্থানগুলোর প্রতি ভ্রমণপিপাসুদের আগ্রহ দিন দিন বাড়ছে। দেশের সাতটি জেলার ৭ লাখ ৮৪ হাজার হেক্টর জলাভূমিতে ৪২৩টি হাওর নিয়ে গঠিত হাওরাঞ্চলে শীত-বর্ষায় হাওরের স্বতন্ত্র রূপ প্রকৃতিপ্রেমীদের দুর্ণিবার আকর্ষণে টেনে নিয়ে যায় পর্যটকদের। এ কারণে বিশাল এ হাওর বাংলাকে কেন্দ্র করে আমাদের পর্যটন শিল্প সমৃদ্ধ হতে পারে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের সমাগমে। হাওরাঞ্চলে যাতায়াতের জন্য রাস্তা নির্মাণ, ডুবু সড়কসহ হাওরের অমসৃণ রাস্তায় চলাচলের উপযোগী মোটরসাইকেলের মতো তিন চাকার বিশেষ বাইক তৈরি করা প্রয়োজন— যাতে চালকসহ তিন-চারজন যাত্রী বহন করা যায়।

স্পোর্টস ট্যুরিজম : বাংলাদেশের স্পোর্টসকে যদি সত্যিকার অর্থে পর্যটনের সঙ্গে সম্পৃক্ত করা যায়, তাহলে নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের পর্যটন শিল্প সমৃদ্ধ হবে। এশিয়ান জার্নাল অন স্পোর্টস অ্যান্ড ইকোনমির একটি আর্টিকেল থেকে জানা যায়, ২০১৪ ও ২০১৫ সালে ক্রীড়া পর্যটনে এশিয়ায় এগিয়ে থাকা দেশগুলো হলো— ভারত ১১ শতাংশ, চীন ১০ শতাংশ, থাইল্যান্ড ৯ শতাংশ, কোরিয়া ৮ শতাংশ, মালয়েশিয়া ৭ শতাংশ, শ্রীলঙ্কা ৫ শতাংশ ও নেপাল ৪ শতাংশ। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এ অংশীদারত্ব ২ ভাগেরও নিচে। আমাদের গ্রামীণ খেলা নৌকাবাইচ, হা-ডু-ডু, লাঠিখেলা, বলি খেলাগুলো যদি বিশ্বে প্রচার করা যায়, তাহলে বাংলাদেশকে Truely Sports Loving Country হিসেবে বহির্বিশ্বে উপস্থাপন করা সম্ভব হবে।

ইসলামিক পর্যটন : পর্যটন শিল্প প্রসারের লক্ষ্যে সৌদি সরকার পবিত্র ওমরাকে অন্তর্ভুক্ত করে ‘ইসলামিক ট্যুরিজমে’র উদ্যোগ নিয়েছে। বাংলাদেশে ধর্মীয় ট্যুরিজমের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে বলে এক গবেষণায় দেখিয়েছেন একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্যুরিজম ও হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্টের শিক্ষক শারমিন সুলতানা। তার গবেষণায় বলা হয়েছে, মসজিদ, মন্দির ও গির্জা পর্যটকদের জন্য আকর্ষণীয় স্থান। একইভাবে বাংলাদেশে বিশ্ব ইজতেমাও হয়। এটিও সুশৃঙ্খলভাবে করতে পারলে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন সম্ভব।

মেডিকেল ট্যুরিজম: বাংলাদেশ ও ভারত উভয় দেশে মেডিকেল ট্যুরিজম প্রসারে বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। দুবাই মেডিকেল ট্যুরিজমের মধ্যে বিশ্বের ১৫টি গন্তব্যের একটি এ অঞ্চলের মধ্যে প্রথম হতে চাইছে। মেডিকেল ট্যুরিজম অ্যাসোসিয়েশনের ২০১৪ সালে প্রকাশিত মেডিকেল ডেস্টিনেশন ইনডেক্স (এমটিডিআই) অনুযায়ী দুবাইয়ের অবস্থান ১৭তম। অ্যারাবিয়ান বিজনেসের খবর অনুযায়ী, ২০১৫ সালের প্রথম প্রান্তিকে স্থানীয় ও বিদেশ থেকে আগত মোট ১ লাখ ১৮ হাজার ৭২৭ জন মেডিকেল ট্যুরিস্টকে (চিকিৎসার জন্য আগত) চিকিৎসাসেবা দিয়েছে দুবাই। মেডিকেল ট্যুরিজমের মাধ্যমে প্রথম প্রান্তিকে প্রায় ২১১ মিলিয়ন ডলার রাজস্ব আয় করেছে দেশটি। দুবাই স্বাস্থ্য নিয়ন্ত্রণ ও ডিএইচএর দুবাই মেডিকেল ট্যুরিজম প্রকল্পের পরিচালক ডা. লায়লা আল মারজোকি জানিয়েছেন, ২০২০ সাল নাগাদ অতিরিক্ত ২০ শতাংশসহ নির্ধারিত ২ দশমিক ৬ বিলিয়নের বেশি রাজস্ব আয় হবে এ খাত থেকে।

মনে রাখা দরকার পর্যটন বিকাশে অবকাঠামো, নিরাপত্তা এবং জিনিসপত্রের মান ও দামের সামঞ্জস্যতা এ তিনটি বিষয়ের খুব গুরুত্বপূর্ণ। পর্যটন শিল্পের বিকাশে সরকার সংশ্লিষ্ট বিভাগ, অধিদফতর ও বেসরকারি উদ্যোক্তাদের সমন্বয়ে একটি নীতিমালা গ্রহণ করলে খুব দ্রুত সুফল পাওয়া সম্ভব হবে।

লেখক: কৃষি-অর্থনীতি বিশ্লেষক ও কলাম

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ