ঢাকা, মঙ্গলবার, ২৮ মার্চ ২০২৩, ১৪ চৈত্র ১৪২৯, ৫ রমজান ১৪৪৪

ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলায় বাংলাদেশ কতটা প্রস্তুত

প্রকাশনার সময়: ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০৮:৩৮

৭.৮ মাত্রার মাত্র এক মিনিটের ভূমিকম্পেই লন্ডভন্ড তুরস্কেও পরিকল্পিত গাজিয়ানতেপ শহর। সঙ্গে প্রতিবেশী দেশ সিরিয়ার সীমান্ত শহরগুলোও। রিখটার স্কেলে যদি সাত মাত্রার ভূমিকম্প হয়, সে ধাক্কা বাংলদেশ সামলাতে পারবে কি? ভূমিকম্প বিশ্লেষকরা বলছেন, কেবল ঢাকায় ধসে পড়বে কয়েক হাজার ভবন, মৃত্যু হবে অন্তত দুই থেকে তিন লাখ মানুষের।

গত ১৫ বছরে ছোট-বড় ভূমিকম্পে ১৪১ বার কেঁপে ওঠে বাংলাদেশ। ২০১৬ সালের ৪ জানুয়ারি ৬ দশমিক ৭ মাত্রার ভূমিকম্পে কেঁপে উঠেছিল বাংলাদেশ। হতাহতের ঘটনাও ঘটেছে সেবার। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ছোট মাঝারি ভূমিকম্পগুলো ভালো বার্তা দেয় না। তা বড় ভূমিকম্পের আলামত বটে! ভূমিকম্পবিদরা বলেন, বড় ভূমিকম্পের শত বছরের মধ্যে আরেকটি বড় ভূমিকম্প হয়। বড় ভূমিকম্পের ইতিহাস বলে শত বছর ঘনিয়ে এসেছে বাংলাদেশের। সে দিক থেকেও আগামী কয়েক বছরের মধ্যে বড় ধরনের ভূমিকম্পের আশঙ্কা প্রকট হয়ে উঠেছে।

বাংলাদেশে ৯ মাত্রার ভূমিকম্পের আশঙ্কার কথাও শুনছি আমরা। আমাদের পত্রিকাগুলো এমন সংবাদই ছাপছে। তাতে করে ভূমিকম্প নিয়ে দেশে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে অনেক। যদি হয় ৯ মাত্রার ভূমিকম্প বাংলাদেশের কি হবে ভাবা কি যায়? যে দেশটার ইট বালি রড সিমেন্ট সব কিছুতেই দুই নাম্বারী সেখানে অপরিকল্পিত বিল্ডিংগুলোর কি হবে? কী হবে জনগণের? এত কিছুর পরেও বাংলাদেশ মোটেও প্রস্তুত নয়। ভূমিকম্প পরবর্তী উদ্ধার কাজের তেমন প্রস্তুতি নেই বাংলাদেশের। এ বিষয়ে বাজেটেও থাকে দুর্বল বরাদ্দ।

দেশের প্রায় সব পত্রিকায় ছাপা হয়েছে ৯ মাত্রার ভূমিকম্প হলে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হবে ঢাকা ও তার আশপাশের এলাকা। বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, এরকম হলে ঢাকা শহরটি নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে তাতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে দেশের ১৪ কোটি মানুষ। কোনো কোনো পত্রিকায় বলা হয়েছে, এ জাতীয় ভূমিকম্পে ৬ থেকে ২০ ফুট উপরে উঠে যাবে মাটি। একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তুরস্কে যে ভূমিকম্প হয়েছে, এর চেয়ে ছোট, অর্থাৎ, রিখটার স্কেলে ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হলেও শুধু ভবন ধস নয়, ঢাকার অপরিকল্পিত বিদ্যুৎ সঞ্চালন ও গ্যাসলাইন এ নগরকে একটি অগ্নিকূপে পরিণত করতে পারে। কয়েক হাজার ভবন ধসে পড়বে। মৃত্যু হতে পারে আড়াই থেকে তিন লাখ মানুষের। কারণ, আমাদের ভবনগুলো এখনও নিরাপদভাবে তৈরি হচ্ছে না। বুয়েটের বিভিন্ন সময়ে করা জরিপে দেখা যায়, ঢাকায় ১৩ লাখ, চট্টগ্রামে ৩ লাখ ও সিলেটে ১ লাখ বহুতল ভবন রয়েছে। এসব ভবনের ৭৫ শতাংশ হচ্ছে ছয়তলা বা তার চেয়েও উঁচু। ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হলে এ ভবনগুলো ও এর বাসিন্দা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। সরকারের সমন্বিত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মসূচির সমীক্ষাতেই বলা হয়েছে, ৭ দশমিক ৫ মাত্রার ভূমিকম্প হলে রাজধানীতে প্রায় ৭২ হাজার ভবন ধসে পড়তে পারে।

বিশেষজ্ঞরা তাদের গবেষণা থেকে বলেছেন, এখনই ভূমিকম্প হবে তা বলা যাবে না তা পাঁচশ’ বছর পরেও হতে পারে। দেশে কোথায় কবে কত মাত্রার ভূমিকম্প হবে কেউ আগেভাগে তা বলতে পারে না। সবই ধারণাপ্রসূত। হতেও পারে নাও হতে পারে। ভূমিকম্প কখন হবে, কবে হবে এবং ভূমিকম্প যেহেতু প্রতিরোধ করা যাবে না তাই এ নিয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করে দেশের মানুষকে আতঙ্কিত করার কোনো মানে হয় না। ভূমিকম্পের বিষয়ে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে, ভূমিকম্প পরবর্তী সময়ে উদ্ধারে প্রস্তুতি থাকতে হবে। জনমনে আতঙ্ক তৈরি না করে জনসচেতনতা তৈরি করতে হবে। জাপানে প্রায়ই ভূমিকম্প হয়। জাপান ভয়কে জয় করেছে। তাই তাদের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ খুবই কম। আমাদের সরকার ও জনগণ ভূমিকম্পের ব্যাপারে সচেতন নয়। ঢাকা শহরে যতগুলো স্থাপনা থাকা দরকার তার চেয়ে ৫০ গুণ স্থাপনা তৈরি হলেও সরকারে এ ব্যাপারে মাথাব্যথা নেই। এখনও এ শহরে স্থাপনা নির্মাণের হরদম অনুমতি দেয়া হচ্ছে। শহর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়, বাণিজ্যিক কার্যালয়, সচিবালয়সহ অন্যান্য অফিস শহরের বাইরে করার পরিকল্পনা সেই বহু আগে নেয়া হয়েছে কিন্তু তার বাস্তবায়নের কোনোই লক্ষণ নেই। উল্লেখিত অফিস-আদালতগুলো শহরের বাইরে হলে ঢাকার ওপর চাপ অর্ধেক কমে যাবে। মানুষ আর ঢাকামুখী হবে না। ঢাকা শহরে লোকজনের বসবাস কমে যাবে। তাতে ঢাকার চাপ কমবে। তখন ভূমিকম্প হলেও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিচে নেমে আসবে।

সরকারের তরফ হতে যন্ত্রপাতি ক্রয় ও স্বেচ্ছাসেবক প্রশিক্ষণের কথা বলা হলেও ভূমিকম্প-পরবর্তী বিপর্যয় সামাল দেয়ার ন্যূনতম প্রস্তুতিও যে আমাদের নেই তা স্পষ্ট। ব্যাপক অভাব রয়েছে জনসচেতনতারও। ভূমিকম্পের ব্যাপারে গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশ, ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ায় ব্যাপক প্রচার-প্রচারণার কোনোটাই সরকারের পক্ষ থেকে করা হচ্ছে না। ইতোমধ্যে অনেক মূল্যবান সময় অপচয় হয়েছে। আর বিলম্ব করা সমীচীন হবে না। ভূমিকম্পের ঝুঁকি মোকাবিলায় সর্বাত্মক প্রস্তুতি গ্রহণের প্রকৃত সময় এখনই। ভূমিকম্প মোকাবিলায় সর্বদা আমাদের নিজেদেরই প্রস্তুত থাকতে হবে। ভূমিকম্পের ঝুঁকি মোকাবিলার ক্ষেত্রে আমাদের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত দুটি। প্রথমত. ভূমিকম্পে ক্ষয়ক্ষতির মাত্রাকে নিম্নতম পর্যায়ে রাখা এবং দ্বিতীয়ত. ভূমিকম্প-পরবর্তী বিপর্যয় সামাল দেওয়া।

বাংলাদেশ বড় মাত্রার ভূমিকম্পের দ্বারপ্রান্তে— বিশেষজ্ঞদের এমন সতর্কবাণীর পর এ বিপদাশঙ্কা উড়িয়ে দেয়া যায় না কিছুতেই। এ অবস্থায় কখন যে ভূমিকম্প আঘাত হানে; কখন যে কে তার শিকার হয়, অজানা এ ভয়ে সবার বুক দুরু দুরু। ২৫ এপ্রিলের ভূমিকম্পের পর আতঙ্ক আরও বেড়েছে। আর এ ভয় যেন জয় করার কোনো উপায় নেই। কখন হবে ভূমিকম্প? এ আতঙ্ক যেন কিছুতেই পিছু ছাড়ছে না। এ আতঙ্ক গোটা দেশবাসীকে পেয়ে বসেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, কেবল ভূমিকম্পই নয়, দেশের উপকূলীয় এলাকা ঘিরে ভয়াবহ সুনামি সৃষ্টির জন্য সাইসমিক গ্যাপ বিরাজমান রয়েছে। এ গ্যাপ থেকে যে কোনো সময় সুনামিও হতে পারে। তাদের মতে, বঙ্গোপসাগরের উত্তরে আন্দামান থেকে টেকনাফ পর্যন্ত সাবডাকশন জোন বরাবর ৬শ’ কিলোমিটারের একটি সাইসমিক গ্যাপ রয়েছে। আমাদের দেশে শক্তিশালী ভূমিকম্প হওয়ার জন্য যথেষ্ট শক্তি এই সাইজমিক গ্যাপে জমা হয়ে আছে। এ সাইজমিক গ্যাপ আমাদের জন্য অশনি সংকেত। এখান থেকে ৮ মাত্রার মতো শক্তিশালী ভূমিকম্প হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। আর তা যদি সাগরতলে হয় তাহলে সেই ভূমিকম্প সুনামি সৃষ্টি করতে পারে। বাংলাদেশে শক্তিশালী ভূমিকম্প এবং সুনামিরই আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। এ অবস্থায় কিছু সতর্কতা অবলম্বন করা হলে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ অনেকাংশে কমে যাবে।

বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ভূমিকম্পে ভবনগুলো সাধারণত হেলে পড়ে। এ সময় নিজেকে রক্ষা করতে হবে। ভিম কিংবা কলামের পাশে শক্ত কোনো কিছুর পাশে থাকতে হবে। বিশেষ করে খাট কিংবা শক্ত ডাইনিং টেবিল হলে ভালো হয়। আগে থেকেই আশ্রয়ের জায়গা ঠিক করে নিতে হবে। ঘরে রাখতে হবে সাবোল এবং হাতুড়ি জাতীয় কিছু দেশীয় যন্ত্র। ভূমিকম্প হলে অনেকেই তড়িঘরি করে নিচে ছোটেন। তারা জানেন না ভূমিকম্পে যত ক্ষতি হয় তার চেয়ে বেশি ক্ষতি হয় অস্থির লোকদের ছোটাছুটিতে। ভূমিকম্প খুব অল্প সময়ের মধ্যে শেষ হয়। প্রলয় যা হবার তা হয় কয়েক সেকেন্ড কিংবা মিনিট সময়ের মধ্যে। এ সময়ে আপনি কি নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে পারবেন? রাস্তায় গিয়ে তো আরও বিপদে পড়তে হবে আপনাকে। বাড়ি ঘর হেলে গিয়ে তো রাস্তার উপরই পড়বে। বরং রাস্তায় থাকলে চাপা পড়ে, মাথা কিংবা শরীরের উপর কিছু পড়ে আপনি হতাহত হতে পারেন। যারা একতলা কিংবা দোতলায় থাকেন পাশে খালি মাঠ থাকেলে দ্রুত দৌড়ে যেতে পারেন। সেখানে যেতে যদি সমস্যা থাকে তাহলে শক্ত কোনো কিছুর আড়ালে অবস্থান নেয়াই শ্রেয়। রাজধানী ঢাকায় যারা বসবাস করেন যারা উঁচু বিল্ডিংয়ে থাকেন এদের ভয়টা একটু বেশি। তাদের জ্ঞাতার্থে বলছি, আমাদের দেশে ৬ তলার উপরে নির্মিত বিল্ডিংগুলো সাধারণত বিল্ডিং কোড মেনেই হয়। বড় বিল্ডিংয় তৈরির ক্ষেত্রে অনেকেই ঝুঁকি নিতে চান না। একটু দেখভাল করেই নির্মাণ করেন। আর এসব বিল্ডিং পাইলিং হয় অনেক গভীর থেকে এবং বেজ ডালাই দেয়া হয় পুরো বিল্ডিংয়ের নিচ জুড়ে তাই শুধু কলামে দাঁড়িয়ে থাকা বিল্ডিং থেকে হাইরাইজ বিল্ডিং কিছুটা হলেও নিরাপদ বলা যায়।

ভূমিকম্প কোথায় হবে, কখন হবে এবং তা কত মাত্রায় হবে তা আগবাড়িয়ে কেউ বলতে পারে না। ভূমিকম্পের বিষয়টি সম্পূর্ণই অনুমেয়। তবে বড় ধরনের ভূমিকম্প হওয়ার কিছু পূর্বলক্ষণ আছে। যা বাংলাদেশে বেশ লক্ষণীয়। এর লক্ষণ হিসেবে প্রায়ই দেশের কোথাও না কোথাও মৃদু ও মাঝারি মাত্রায় ভূমিকম্প হচ্ছে।

ভূমিকম্প নিয়ে কমবেশি আতঙ্ক সবার মধ্যেই আছে। ছবির মতো সুন্দর তুরস্কে ভূমিকম্পে যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তাতে বাংলাদেশেও অনেকে আতঙ্কে ভুগতে পারেন। আতঙ্কিত হলে চলবে না। ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি ন্যূনতম পর্যায়ে রাখার জন্য এ বিষয়ে ব্যাপক জনসচেতনতা গড়ে তুলতে হবে। সরকারকেই এ বিষয়ে মুখ্য দায়িত্ব পালন করতে হবে, যাতে সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ন্যূনতম পর্যায়ে থাকে। একটি ভবন নির্মাণের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান সব নিয়ম মেনে করছে কি না, তা কঠোরভাবে তদারক করতে হবে। ভূমিকম্প-পরবর্তী উদ্ধার কাজের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা রাখতে হবে।

লেখক: সাংবাদিক, কলামিস্ট ও সমাজ গবেষক

নয়া শতাব্দী/জেআই

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ