নয়া শতাব্দী অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি।
বর্তমানে বাজারে প্যাকেটজাত চিনি প্রতি কেজি ১২০ টাকা। বাংলাদেশে প্রতি বছর চিনির চাহিদা রয়েছে ১৮ থেকে ২০ লাখ টন। দেশের চিনি কলগুলো অর্থাৎ রাষ্ট্রায়ত্ত চিনি কলগুলো উৎপাদন করতে পারে বছরে ১ লাখ টন। বাকি চিনি বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্যশিল্প করপোরেশনের সুগারের মিলের সংখ্য ১৫টি। সুগার মিলগুলো বহু পুরোনো। প্রতিটি সুগার মিলের তথ্য পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, তাদের জীর্ণশীর্ণ অবস্থা। দেশের সুগার মিলগুলো তথ্যচিত্র ঘাঁটলে যা দেখা যায় তা হলো—শ্যামপুর চিনিকল রংপুর জেলায় অবস্থিত। মিলটি ১৯৬৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এর বার্ষিক উৎপাদন ক্ষমতা ১০ হাজার ১৬১ মেট্রিকটন। সেতাবগঞ্জ সুগার মিলটি দিনাজপুর জেলায় অবস্থিত। এ সুগার মিলটি বহু পুরোনো। ১৯৩৩ সালে দিনাজপুর জেলার বোচাগঞ্জে এ মিলটি প্রতিষ্ঠিত হয়। এর নির্দিষ্ট উৎপাদন সক্ষমতার সঠিক তথ্য জানা যায়নি।
রাজশাহী চিনিকলটি ১৯৬২ সালে জেলার হরিয়ানে প্রতিষ্ঠিত হয়। এ মিলটির দৈনিক আখ মাড়াই ক্ষমতা ২ হাজার মেট্রিক টন। এবং চিনি উৎপাদনের ক্ষমতা ২০ হাজার মেট্রিকটন। রংপুর চিনিকলটি মহিমাগঞ্জে ১৯৫৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। এ মিলটির দৈনিক আখ মাড়াইয়ের ক্ষমতা ১৫০০ মেট্রিক টন। এ হিসাবে বার্ষিক চিনি উৎপাদন হয় ১৫ হাজার মেট্রিকটন। ঝিনাইদহ জেলার কালীগঞ্জ উপজেলায় মোবারকগঞ্জে মোবারকগঞ্জ সুগার মিলটি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৬৫ সালে। এ মিলটির বার্ষিক উৎপাদন ক্ষমতা ১২ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন।
১৯৭৪ সালে ফরিদপুরের মধুখালীতে ফরিদপুর সুগার মিলটি প্রতিষ্ঠিত হয়। এ মিলটি ১ হাজার ১৬ মেট্রিকটন আখ দৈনিক মাড়াই করতে পারে। এ হিসাবে বার্ষিক চিনি উৎপাদন ক্ষমতা ১০ হাজার ১৬০ মেট্রিক টন। পাবনা সুগার মিলটি ১১৯২ সালে ঈশ্বরদীতে প্রতিষ্ঠা পায়। মিলটির দৈনিক আখ মাড়াইয়ের ক্ষমতা ১ হাজার ৫০০ মেট্রিকটন। সে হিসেবে মিলটির বার্ষিক চিনি উৎপাদনের ক্ষমতা ১৫ হাজার মেট্রিকটন। পঞ্চগড় সুগার মিলটি ১৯৬৫ সালে জেলার ধাক্কামারা এলাকায় প্রতিষ্ঠা পায়। মিলটির উৎপাদন ক্ষমতা প্রায় ১৫ হাজার মেট্রিকটন। নাটোর সুগার মিলটি ১৯৮২ সালে সদর উপজেলায় প্রতিষ্ঠা করা হয়। মিলটির বার্ষিক উৎপাদন ক্ষমতা ১৫ হাজার মেট্রিকটন। নর্থ বেঙ্গল সুগার মিলটি নাটোর জেলার লালপুরে অবস্থিত, এ মিলটি ১৯৩৩ সালে প্রতিষ্ঠিত। এর বার্ষিক উৎপাদন ক্ষমতা ১৫ হাজার মেট্রিকটন। ঠাকুরগাঁও সুগার মিলটি ১৯৫৬ সালে ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলায় স্থাপন করা হয়। এ মিলটির বার্ষিক উৎপাদন ক্ষমতা ১৫ হাজার ২৪০ মেট্রিকটন। জামালপুর জেলার দেওয়ানগঞ্জে ১৯৫৭ সালে ঝিল বাংলা সুগার মিলটি স্থাপিত হয়। মিলটির বার্ষিক উৎপাদন ক্ষমতা ১০ হাজার ১৫০ মেট্রিকটন।
জয়পুরহাটের সদর উপজেলায় অবস্থিত জয়পুরহাট সুগার মিলটি ১৯৬০ সালে গড়ে ওঠে। এর বার্ষিক উৎপাদন ক্ষমতা ২০ হাজার মেট্রিকটন। চুয়াডাঙ্গা জেলার দর্শনায় কেরু এন্ড কোং নামে দেশের বৃহতম সুগার মিলটি অবস্থিত। কেরু এন্ড কোং ১৯৩৮ সালে স্থাপিত হয়। মিলটির দৈনিক আখ মাড়াই ক্ষমতা ১ হাজার ১৫০ মেট্রিকটন। বছরে ১১ হাজার ৫০০ মেট্রিকটন চিনি উৎপাদন করতে পারে। কুষ্টিয়ার জগতিতে কুষ্টিয়া সুগার মিলটি অবস্থিত। মিলটি স্থাপিত হয় ১৯৬১ সালে, উৎপাদন ক্ষমতা ১৫ হাজার মেট্রিকটন। তা ছাড়া লোকসানি প্রতিষ্ঠান হওয়ায় নরসিংদীর পলাশের দেশবন্ধু সুগার মিল এবং কিশোরগঞ্জের কালিয়াচাপড়া সুগার মিল বন্ধ করে দেয়া হয়। চিনি পরিশোধন করে পাশাপাশি বাজারজাত করে এমন কয়েকটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে তাদের মধ্যে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ এ আব্দুল মোমেন সুগার রিফাইনারি লিমিটেড যার বার্ষিক উৎপাদন ক্ষমতা তিন লাখ মেট্রিকটন, এটি প্রতিষ্ঠা পায় ২০০৬ সালে, ২০০৫ সালে ব্যক্তি উদ্যোগে একই উপজেলার ইউনাইটে সুগার মিল স্থাপিত হয় যার বার্ষিক উৎপাদন ক্ষমতা সাড়ে সাত লাখ মেট্রিকটন। চিটাগাং এ এস আলম গ্রুপের কর্ণফুলী সুগার মিলটি ২০০৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়, যার বার্ষিক উৎপাদন ক্ষমতা ৮ লাখ ৪০ হাজার মেট্রিকটন। নারায়ণগঞ্জ জেলার রূপগঞ্জে ২০০৪ সালে পারটেক্স গ্রুপ একটি সুগার মিল স্থাপন করে যার উৎপাদন ক্ষমতা সাড়ে চার লাখ মেট্রিকটন। এ জেলার রুপসিতে সিটি গ্রুপ একটি সুগারমিল স্থাপন করে ২০১১ সালে, যার উৎপাদন ক্ষমতা ১৫ লাখ মেট্রিকটন। প্রশ্নটা সহজেই এসে যায়, কেন রাষ্ট্রায়ত্ত কারখানাগুলো সময়ে সঙ্গে এবং জনসংখ্যার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে নিজেদের উৎপাদন বাড়াতে পারেনি? এর জন্য দায়ী কে? বেসরকারি মিলগুলো স্থাপনের পরপরই তাদের উৎপাদনের সক্ষমতা বাড়াতে পারলে রাষ্ট্রায়ত্ত মিলগুলো কেন পারল না। বেসরকারিভাবে প্রতিষ্ঠিত প্রতিটি সুগার মিলগুলো মূলত রিফানারির কাজ করে থাকে। তারা বিদেশ থেকে অপরিশোধিত চিনি এনে শোধন করে বাজারজাত করছে। বেসরকারি মিলগুলো একত্রিত হয়ে কাজ করে। ফলে তারা সহজেই সিন্ডিকেট তৈরি করতে পারে। বিভিন্ন সময়ে আন্তর্জাতিক বাজারে বা ট্যাক্স ভ্যাট বৃদ্ধি বা শুল্ক বৃদ্ধি এসব ধরনের অজুহাত দেখিয়ে তারা চিনির দাম বাড়িয়ে দেয়, ফলে চিনির দাম লাগামহীন হয়ে যায়। চিনিশিল্প গড়ে ওঠে কাঁচামাল অর্থাৎ আখ উৎপাদনকারী অঞ্চলের ওপর ভিত্তি করে। বাংলাদেশের রাষ্ট্রায়ত্ত চিনি কলগুলো সিংহভাগই উত্তর বঙ্গে অবস্থিত। খাদ্য ও শিল্প করপোরেশনের সুগার মিল এলাকায় আখ চাষের জোনভিত্তিক করে ভাগ করা আছে। প্রতিটি সুগার মিলের আখ সংগ্রহের জন্য রয়েছে নিজস্ব ক্রয় কেন্দ্র। একটি ক্রয় কেন্দ্র যে পরিমাণের আয়তনের ভূমি রয়েছে সেই পরিমাণের জায়গা একটি বেসরকারিভাবে প্রতিষ্ঠিত রিফাইনারি সুগার মিলের নেই। তারপরও রাষ্ট্রায়ত্ত সুগার মিলগুলো তাদের উৎপাদন বাড়তে পারছে না। রাষ্ট্রায়ত্ত সুগার মিলের লোকসানের পরিমাণ প্রতি অর্থবছরে প্রায় গড়ে ৯৭০ কোটি টাকা। বিভিন্ন তথ্যানুসারে জানা যায়, রাষ্ট্রায়ত্ত সুগার মিলে প্রতি কেজি চিনি উৎপাদন করতে খরচ পড়ে প্রায় ১২০ টাকা। উৎপাদন ব্যয় এত বেশি কেন? এ মিলগুলোর আধুনিকায়ন করা হয়নি। প্রশ্ন হলো ৯০ বছর আগে স্থাপিত সুগার মিলটির যন্ত্রপাতি কেন আধুনিক করা হয় না?
অথচ দেশের সেতু কালভার্ট সরকারি ভবন যা ভৌত অবকাঠামো, সেগুলো পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, ৯০ বছর আগের কোনো রাস্তাঘাট, সরকারি অফিস ভবন, কর্মচারী বাসভাবন সংস্কার করার বাকি নেই। দৃশত এ উন্নয়নটা সবার চোখে ধরা পড়ে। এ উন্নয়নের ফলে সরকারি কোষাগারে কতটা লাভ জমা হয়? তার হিসাবটা করা দরকার, এ ধরনের উন্নয়নে দেশের সাধারণ মানুষের কর্মসংস্থানেরও সুযোগ হয় না। লোকসানি প্রতিষ্ঠান হওয়ায় বেশ কিছু সুগার মিল বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। ফলে কৃষকসহ মানুষের মাঝে বাড়ছে বেকারত্ব।
আখ চাষিদের কাছ থেকে ক্রয় করা আখের মূল্য সময়মতো পরিশোধ করা হয় না। বেসরকারিভাবে স্থাপিত মিলগুলো বিদেশ থেকে ম্যাটেরিয়াল কিনে এনে দেশে রিফাইন করে লাভ করতে পারছে অথচ দেশের উৎপাদিত কাঁচামাল ব্যবহার করে সরকারি সুগার মিলগুলো কেন লোকসানি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়ে যাচ্ছে। তার কারণগুলো অনুসন্ধান করে জনসম্মুখে উপস্থাপন করা দরকার। দেশের মোট চিনির চাহিদা ১৮ থেকে ২০ লাখ টন। এ চাহিদার জোগান মাত্র এক লাখ টন রাষ্ট্রায়ত্ত ১৫টি চিনি কল দিতে পারে, অপরদিকে বেসরকারিভাবে স্থাপিত ৬টি সুগার মিল বাকি ১৭-১৯ লাখ টন চিনি জোগান দিচ্ছে। খাদ্য ও চিনিশিল্প প্রতিষ্ঠানের বিরাট লাভের অঙ্ক নিয়ে যাচ্ছে ব্যবসায়ীরা। এটা কি সরকারের দক্ষতার পরিচয় বহন করে? অথচ কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়ন হচ্ছে এ উন্নয়নের সুফলটা মূলত ব্যবসায়ী ও পুঁজিপতিরাই ভোগ করে, তৃণমূলে সাধারণ মানুষের ভাগ্যে এর কোনো সুফল আসে না।
দেশীয় কাঁচামাল ব্যবহার করে দেশের ভেতরে শিল্পায়নের প্রসার ঘটাতে পারলে সাধারণ জনগণ তার সুফলটা পাবে আর এটাই হবে দেশের জন্য প্রকৃত উন্নয়ন।
লেখক: কলামিস্ট
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ