নয়া শতাব্দী অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি।
পর্যটন বর্তমানে সারা বিশ্বেই দ্রুত বিকাশমান একটি শিল্প। ত্বরিত বিকশিত এ শিল্পের মাধ্যমে বাংলাদেশসহ অনেক দেশ প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয় করে থাকে। মালদ্বীপসহ বিশ্বের কয়েকটি দেশের প্রধান আয়ের খাত হচ্ছে পর্যটন শিল্প। অবশ্য অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশ এক্ষেত্রে অনেক পিছিয়ে রয়েছে। এমনকি নিকট প্রতিবেশী ভারত, নেপালের চেয়েও পিছিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ। অথচ বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পের সম্ভাবনা খুবই উজ্জ্বল। যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ করা হলে বাংলাদেশ হতে পারে বিশ্বের অন্যতম প্রধান পর্যটক গন্তব্য। বাংলাদেশের পর্যটন স্পটগুলো সাধারণত প্রাকৃতিক। কৃত্রিমভাবে সৃষ্ট পর্যটন স্পট অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে খুবই কম। অবশ্য কৃত্রিম পর্যটন স্পট গড়ে তোলার মতো সামর্থ্যও বাংলাদেশের খুব একটা নেই। অবশ্য তার প্রয়োজনও নেই। এক্ষেত্রে প্রকৃতির দানই যথেষ্ট। পর্যটক আকৃষ্ট করতে সক্ষম এমন মনোমুগ্ধকর আকর্ষণীয় পর্যটন স্পট বিশ্বের অন্যান্য দেশে বিরল। একটানা ১২০ কিলোমিটার আয়তনের পৃথিবীর বৃহত্তম সমুদ্র সৈকতের অবস্থান বাংলাদেশে। বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ সুন্দরবন তাও বাংলাদেশে। এক কথায় প্রকৃতির অপরূপ লীলাভূমি বাংলাদেশ। প্রকৃতি যেন নিজ হাতে বাংলাদেশকে পর্যটকদের ভ্রমণ পিপাসা মেটানোর জন্য অপরূপ রূপে সাজিয়ে রেখেছেন। পর্যটন শিল্প উদ্যোক্তাদের কৃত্রিম পর্যটন শিল্প গড়ে তোলার জন্য প্রচুর অর্থ বিনিয়োগের কোনো প্রয়োজন নেই। প্রকৃতির দানের ওপর ব্যবসা-বাণিজ্য করা যাচ্ছে অনায়াসে। যা অন্য কোনো শিল্পে কল্পনাও করা যায় না।
এরপরও কিন্তু বাংলাদেশের পর্যটন শিল্প এখন পর্যন্ত কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছতে পারেনি। কেননা এ শিল্পের বিকাশে নানা অন্তরায় রয়েছে। প্রধান অন্তরায় হিসেবে চিহ্নিত করা হয় অবকাঠামোগত অনুন্নয়ন ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে। কিন্তু আরেকটি অন্তরায় আছে যা প্রধানতম অন্তরায় না হলেও গুরুত্বপূর্ণ। তা হচ্ছে প্রচার প্রচারণার অভাব। বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পের বাস্তব পরিস্থিতি দেশবাসী ও বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরা পর্যটন শিল্পের বিকাশের অন্যতম শর্ত। প্রচারে প্রসার একথা পর্যটন শিল্পের ক্ষেত্রেও সমভাবে প্রযোজ্য। তবে তা অবশ্যই ইতিবাচক প্রচার। কেননা গণমাধ্যমে নেতিবাচক প্রচারের কারণে ব্যাপক সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও বিশ্বের অনেক দেশ পর্যটকশূন্য। গণমাধ্যম কর্তৃক ‘সন্ত্রাসী রাষ্ট্র’ হিসেবে প্রচারিত হওয়ার কারণে প্রকৃতির অপরূপ লীলাভূমি দর্শনে কোনো পর্যটক যেতে আগ্রহবোধ করে না। ওইসব রাষ্ট্রে ‘সন্ত্রাসী’ কার্যক্রম যতটা ছিল তারচেয়ে বেশি গণমাধ্যমে প্রচার হয়েছে। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে সন্ত্রাসী লেবেল সেটে দেয়ার পরিণতি আজও ওই দেশের জনগণ ভোগ করছে। গণমাধ্যম যেমন নেতিবাচক লেবেল সেটে দিতে পারে তেমনি ইতিবাচক লেবেলও সেটে দিতে পারে। যার অনেক দৃষ্টান্ত রয়েছে।
কোনো বিষয় বা বস্তু বা পণ্য সম্পর্কে যথাযথভাবে প্রচার না হলে তা কাছের মানুষও জানতে পারে না। যে কোনো পণ্যসেবা বিক্রয়ের জন্য বিভিন্নভাবে প্রচার চালানো বাধ্যতামূলক। তবে অবশ্যই ইতিবাচক প্রচারণা। সঠিকভাবে প্রচার-প্রচারণা না হলে ভোক্তা পণ্য বা সেবা সম্পর্কে আগ্রহী হবে না। আর নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পের প্রচার-প্রচারণা দেশ-বিদেশে কোথাও যথাযথভাবে হচ্ছে না। যে কারণে কেবল বিদেশি নয় দেশি পর্যটকও আকৃষ্ট হচ্ছে না। কেবল গণমাধ্যমই পারে খুব সহসা যে কোনো পণ্য বা সেবা জনসাধারণের সামনে তুলে ধরতে। যে কোনো বিষয়ে জনগণের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনে গণমাধ্যম কার্যকর হাতিয়ার। মুহূর্তের মধ্যে যে কোনো পণ্য বা সেবার খবর ভোক্তার কাছে পৌঁছে দিতে পারে গণমাধ্যম। গণমাধ্যমের রয়েছে বহুমাত্রিক ক্ষমতা। ইতিবাচক নেতিবাচক উভয় ভূমিকাই রয়েছে গণমাধ্যমের।
গণমাধ্যমের বিভিন্ন সেগমেন্ট যেমন মুদ্রণ মাধ্যম তথা দৈনিক পত্রিকা, সাময়িকী, পুস্তক পুস্তিকা ইত্যাদি, ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া যথা রেডিও, টেলিভিশন, সর্ব সাম্প্রতিক ওয়েব মিডিয়া যা অনলাইন মিডিয়া নামে পরিচিত। চলচ্চিত্র ও অন্যান্য ট্রেডিশনাল মিডিয়া নিজ নিজ অবস্থান থেকে স্ব স্ব পদ্ধতিতে পর্যটন শিল্পের বিকাশে ইতিবাচক প্রচার-প্রচারণা চালাতে পারে। সর্বোপরি বর্তমান সময়ের ট্রেন্ড সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম পর্যটন খাতের বিকাশে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। সহসাই নাগরিক সাংবাদিকরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পর্যটন খাতের প্রচারে অংশগ্রহণ করতে পারেন। এক্ষেত্রে নাগরিক সাংবাদিকরা মূলধারার সাংবাদিকদের সঙ্গে সম্পূূরক সাংবাদিকতা করতে পারে।
মুদ্রণ মাধ্যম : মুদ্রণ মাধ্যমের সবচেয়ে শক্তিশালী ও জনপ্রিয় মাধ্যম হচ্ছে দৈনিক পত্রিকা। যা প্রতিদিন সকালে জনগণের কাছে সর্বশেষ খবর নিয়ে হাজির হয়। এর গ্রহণযোগ্যতাও জনগণের কাছে বেশি। দৈনিক পত্রিকাগুলো ধারাবাহিকভাবে দেশের পর্যটন স্পটগুলো নিয়ে সচিত্র প্রতিবেদন করতে পারে। যে প্রতিবেদনের মাধ্যমে পাঠক পর্যটন স্পট সম্পর্কে অবগত হয়ে পর্যটনে আকৃষ্ট হয়। পর্যটন স্পট নিয়ে নিয়মিত ফটোফিচার প্রকাশ করা যেতে পারে। যেমন কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত, কুয়াকাটা, পার্বত্য চট্টগ্রাম, সুন্দরবনসহ অন্যান্য অপরিচিত পর্যটন স্পট নিয়ে রিপোর্ট, ফিচার, ফটোফিচার প্রকাশিত হলে সংবাদ পাঠের পর বাস্তবে ভ্রমণের ইচ্ছা জাগরিত হবে। এছাড়া দৈনিক পত্রিকাগুলো সম্পদকীয়, উপ-সম্পাদকীয়র মাধ্যমে পর্যটন শিল্পের সম্ভাবনা ও সমস্যার বিশ্লেষণ তুলে ধরে সরকারকে, সংশ্লিষ্ট উদ্যোক্তাদের সুপারিশ করতে পারে। আবার দৈনিক পত্রিকাগুলো পর্যটন বিষয়ে সাপ্তাহিক বিশেষ পাতা প্রকাশ করতে পারে। এ ক্ষেত্রে নাগরিক সাংবাদিকতার সংযোগ ঘটানো যেতে পারে। অর্থাৎ পর্যটন নিয়ে লেখালেখিতে আগ্রহী নাগরিকদের প্রদায়ক হিসেবে নেয়া যেতে পারে। পুস্তক, পুস্তিকা জনপ্রিয় মাধ্যম। বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পের সামগ্রিক পরিবেশ পরিস্থিতি নিয়ে সচিত্র বই প্রকাশ করা যেতে পারে। আবার বিশেষ বিশেষ পর্যটন স্পট নিয়ে সচিত্র পুস্তিকা প্রকাশ করা যেতে পারে। আবার পর্যটন নিয়ে স্পটকেন্দ্রীক প্রামাণ্য গ্রন্থ প্রকাশ করা যেতে পারে। পুস্তক, পুস্তিকা বা প্রামাণ্যগ্রন্থ সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতর বা পর্যটন ব্যবসার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো এই প্রকাশনার দায়িত্ব পালন করতে পারে। অথবা স্বউদ্যোগী লেখকদের সরকার ও পর্যটন ব্যবসা কোম্পানিগুলো স্পনসর করতে পারে। প্রকাশনাগুলো বাংলার পাশাপাশি ইংরেজিতে হওয়া উচিত।
রেডিও : রেডিও প্রাচীন ও জনপ্রিয় একটি মাধ্যম। মুদ্রণ মাধ্যমের মতো রেডিও পর্যটন শিল্পের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ বেতারের বিভিন্ন কেন্দ্র, বেসরকারি এফ এম রেডিও, কমিউনিটি রেডিও পর্যটন স্পট নিয়ে বিশেষ প্রতিবেদন, রেডিও ফিচার, রেডিও ডকুমেন্টারি প্রচার করতে পারে। আবার পর্যটন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সাক্ষাৎকার প্রচার ও পর্যটন বিষয়ে টকশো প্রচার করতে পারে। এর মাধ্যমে শ্রোতারা দেখতে না পেলেও বিবরণীর মাধ্যমে বিভিন্ন পর্যটন স্পট সম্পর্কে সাধারণ ধারণা লাভ করতে পারবে। এক্ষেত্রে স্থানীয় পর্যটন স্পটগুলো কমিউনিটি রেডিও সহসাই শ্রোতাদের সামনে উপস্থাপন কররতে পারে।
টেলিভিশন: ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার মধ্যে টেলিভিশন আধুনিক ও খুবই জনপ্রিয় মাধ্যম। শব্দ-দৃশ্যর অপূর্ব সমন্বয়ের মাধ্যমে কোনো ঘটনাকে দর্শকের সামনে জীবন্তরূপে উপস্থাপন করে টিভি মিডিয়া। যে কারণে টিভি সংবাদের গ্রহণযোগ্যতা বেশি। আর সে কারণে পর্যটন শিল্পের বিকাশে টিভি মিডিয়ার গুরুত্বও বেশি। টিভি চ্যানেলগুলো পর্যটন স্পট নিয়ে বিশেষ প্রতিবেদন, টিভি ডকুমেন্টারি, টকশো প্রচার করতে পারে। যেমন কোনো একটি পর্যটন স্পট নিয়ে টিভিতে বিশেষ প্রতিবেদন বা ডকুমেন্টারি প্রচার হয় তাহলে দর্শকের ওই স্পট সম্পর্কে আগ্রহ জন্মাবে।
ওয়েব মিডিয়া : ওয়েব মিডিয়া বা অনলাইন মিডিয়াও পর্যটন শিল্পের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। বর্তমানে অনলাইন মিডিয়া খুবই জনপ্রিয়। আর অনলাইন মিডিয়া-তো একটি সমন্বিত মাধ্যম। অনলাইন পত্রিকা, রেডিও, টেলিভিশন সবই আছে। যে কারণে সংবাদপত্র, রেডিও, টেলিভিশনের অনুরূপ ভূমিকা অনলাইন মিডিয়াও পালন করতে পারে। আবার অনলাইন ভিত্তিক সোশ্যাল মিডিয়া যেমন ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউব পর্যটন শিল্পের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। মূলধারার সংবাদ মাধ্যম তথা পত্রিকা, রেডিও, টেলিভিশন নিজেদের প্রচারের জন্য সোশ্যাল মিডিয়া নির্ভর হয়েছে। পর্যটন শিল্পের বিকাশে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম শক্তিশালী ভূমিকা পালন করতে পারে। কারণ এখানে রয়েছে নাগরিক সাংবাদিতকার অবাধ সুযোগ। রাষ্ট্রযন্ত্র্রও কোনো ধরনের নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে পারে না। অনেকেই স্বতঃস্ফূর্তভাবে ফেসবুকে ও ইউটিউবে পর্যটন বিষয়ক ভিডিও আপলোড করছে। এক্ষেত্রে সরকারের পর্যটন দফতর ও পর্যটন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো স্পনসরের মাধ্যমে তাদের প্রয়োজন অনুযায়ী প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করাতে পারে। যা ভিডিও ব্লগাররা তাদের পেজে আপলোড করবেন। যে কোনো দেশের পর্যটন স্পট বিশ্বব্যাপী দর্শকদের সামনে তুলে ধরার সহজ মাধ্যম হচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়া। যে কারণে দেশজ পর্যটন শিল্প বিকাশে সরকার ও পর্যটন উদ্যোক্তারা আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ভিডিও ব্লগারদের সহযোগিতা গ্রহণ করতে পারে। তাদের স্পন্সর করে দেশে এনে পর্যটন খাতের ওপর বিশেষ ডকুমেন্টারি তৈরি করা যেতে পারে। বাংলাদেশের পর্যটন খাতের ওপর নির্মিত আদিষ্ট প্রামাণ্যচিত্র সোশ্যাল মিডিয়ায় তাদের বহুল জনপ্রিয় পেজে আপলোড করলে; বিশ্বব্যাপী বাংলাাদেশের পর্যটন নিয়ে ইতিবাচক ইমেজ তৈরি হবে। আবার পর্যটন ব্যবসায়ীদের উদ্যোগেও এই সোশ্যাল সাইটে পর্যটন স্পটের চিত্র বিবরণী পোস্ট করা যেতে পারে।
স্থির চিত্র ও চলমান চিত্র : পর্যটন স্পট নিয়ে স্থির চিত্র প্রদর্শনী হতে পারে। যেমন অপরূপ কক্সবাজার শীর্ষক স্থির চিত্র প্রদর্শনী দেশে বিদেশে হতে পারে। ভিডিও প্রদর্শনী যেমন ‘রূপময় বাংলাদেশ’ শীর্ষক বাংলাদেশকে নিয়ে সংক্ষিপ্ত ভিডিও নির্মাণ ও প্রদর্শন হতে পারে। আবার স্পটকেন্দ্রিক যেমন ‘অপরূপ সুন্দরবন’ শীর্ষক ভিডিও নির্মাণ ও প্রদর্শনীর আয়োজন হতে পারে। বিদেশস্থ বাংলাদেশে দূতাবাসের মাধ্যমে প্রদর্শনীর আয়োজন করলে সহসাই বিদেশি পর্যটক আকৃষ্ট করা যাবে। আর এভাবেই গণমাধ্যম বিশ্বের পর্যটকদের সামনে বাংলাদেশকে সহসাই উপস্থাপন করতে পারে।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ