নয়া শতাব্দী অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি।
প্রিয় মানুষকে সঙ্গে নিয়ে মেলায় এসেছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া কামরুজ্জামান ও নীলুফার। নীলুফার পরনে বাসন্তী শাড়ি আর কামরুজ্জামানের পরনে ঘিয়ে রঙা পাঞ্জাবি। তাদের সঙ্গে কথা হয়, বইমেলা, বসন্ত ও ভালোবাসা দিবস নিয়ে।
কামরুজ্জামান জানালেন, ‘কয়েক বছর আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের বকুলতলায় বসন্তবরণ অনুষ্ঠানে পরিচয় হয় নীলুফারের সঙ্গে। মাত্র একদিনের পরিচয়ে তার ডাকে সাড়া দিয়ে পরদিন ভালোবাসা দিবসে বইমেলায় আসে নীলুফার। ওই দিনের কয়েক ঘণ্টা আলাপে মুগ্ধ হয়ে একগুচ্ছ বই কিনে গুঁজে দেন নীলুফারের হাতে। নীলুফা প্রথমে সংকোচ করলেও পরে বইগুলো নেন। এরপর মোবাইল ফোনে চলতে থাকে তাদের আলাপন। ফেসবুকের ম্যাসেঞ্জারে চ্যাটিং। এক সময় তাদের সম্পর্ক নিটোল প্রেমে পরিণত হয়। তারা সিদ্ধান্ত নেন প্রতিবছর ভালোবাসা দিবসে বইমেলায় আসবেন এবং একে অপরকে বই কিনে উপহার দেবেন। সে কারণেই তাদের মেলায় আসা। যদিও এখন বসন্ত ও ভালোবাসা দিবস পালিত হচ্ছে একই দিনে।
ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী জাফনাহ তার প্রিয় মানুষ সাজ্জাদকে নিয়ে এসেছেন মেলায়। তার পরনেও বাসন্তী শাড়ি। তিনি বলেন, ‘ভালোবাসা তো প্রতিদিনের। কিন্তু ভালোবাসা দিবস আসে মনকে অন্যরকম রঙে রাঙিয়ে দিয়ে। সেই সঙ্গে ফাগুনও। একটা দিন সবকিছু ভুলে শুধু ভালোবাসা আর ভালোবাসা। তার কথায় সায় দিয়ে তার সঙ্গে থাকা প্রিয় মানুষ হেসে উত্তর দেন ‘ভালোবাসি ভালোবাসি ভালোবাসি এই বসন্ত দিনে’।
মঙ্গলবার (১৪ ফেব্রয়ারি) বিকাল তিনটায় মেলার দ্বার খুলে যেতেই মুখরিত হয়ে ওঠে মেলা প্রাঙ্গণ। প্রিয়জনকে সঙ্গে নিয়ে মেলায় আসতে শুরু করেন নানা বয়সি মানুষ। তাদের মধ্যে তরুণ-তরুণীরাই বেশি ছিল। পহেলা ফাল্গুন ও বিশ্ব ভালোবাসা দিবস কেন্দ্র করে বিভিন্ন বয়সি বিশেষ করে প্রেমিক যুগলের পদচারণায় মুখর ছিল মেলার দুই প্রাঙ্গণ। শুধু মেলায় ঘোরাঘুরি নয়, কবিতা, গল্প আর উপন্যাসের বই কিনে দেন প্রিয় মানুষের হাতে। সেই বইয়ের মলাটের ফাঁকে গুঁজে দেন ভালোবাসায় সিক্ত গোলাপ কলিটিও। হাতে হাত রেখে পরস্পরের উষ্ণতা অনুভব করেছেন। যুগলবন্ধনে হেঁটে চলেন মেলার স্টল-প্যাভিলিয়নে। বর্ণিল পোশাকের রংবাহারে মেলা হয়ে উঠেছে রঙিন।
তবে বাসন্তী রঙের ছড়াছড়ি ছিল ব্যাপক। কেউ কেউ এসেছিলেন নীল বসনে। বসন্ত ও ভালোবাসা দিবসের প্রভাবেই অন্য দিনের চেয়ে বই বিক্রিও হয়েছে ব্যাপক ভালো। যদিও এবার শুরু থেকেই বিক্রি খারাপ যাচ্ছে না, অন্তত প্রকাশকরা তাই বলছেন। বসন্ত-ভালোবাসা দিবসে ক্রেতাদের পছন্দের ক্ষেত্রে গল্প-উপন্যাসই ছিল শীর্ষে। এ সবের বেশিরভাগই কেনা হয়েছে ভালোবাসার মানুষকে উপহার দেয়ার জন্য। উপহার বিনিময়ে মধুর ভালোবাসায় অবগাহন করছেন যুগলরা। এবারও মেলার প্রথম দিন থেকেই উপন্যাসের বিকিকিনি ভালো। গতকালও উপন্যাস ভালো বিক্রি হয়েছে।
একাধিক প্রকাশক জনালেন, ‘বসন্ত ও ভালোবাসা দিবস কেন্দ্র করে প্রেমের উপন্যাসগুলোর চাহিদা বেশি। বিশেষ করে হুমায়ূন আহমেদ এখনও শীর্ষে। এর পর ছিল মুহম্মদ জাফর ইকবাল, ইমদাদুল হক মিলন, আনিসুল হক, আহসান হাবীব, হরিশংকর জলদাসসহ খ্যাতিমান লেখকদের গল্প-উপন্যাস। পিছিয়ে নেই কবিতার বইও। সৈয়দ শামসুল হক, মহাদেব সাহা, নির্মলেন্দু গুণ, রফিক আজাদ, মুহম্মদ নূরুল হুদাসহ জনপ্রিয় কবিদের পাশাপাশি হালে জনপ্রিয় হয়ে ওঠা কবিদের কাব্যগ্রন্থ বিক্রি হচ্ছে।
কাকলী প্রকাশনীর রেজাউল করিম বলেন, ‘আমাদের এখানে উপন্যাস বেশি বিক্রি হচ্ছে। নির্মলেন্দু গুণের বই ছাড়া অন্য কবিতার বই তেমন বিক্রি হচ্ছে না। উপন্যাসের পাঠক বেশি, তারা এসে পছন্দের লেখকের উপন্যাস খোঁজেন। কেউ কেউ লিস্ট ধরে উপন্যাস কেনেন।’
অন্যপ্রকাশের বিক্রয়কর্মী নাহিদ হাসনান বলেন, ‘আমাদের প্যাভিলিয়নে উপন্যাসের চাহিদা বেশি। তবে হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাসের চাহিদা সবচেয়ে বেশি। এরপর সাদাত হোসাইন, মৌরি মরিয়মসহ নতুন কিছু লেখক আছেন, তাদেরও পাঠক তৈরি হচ্ছে।’
বাংলা একাডেমির জনসংযোগ উপবিভাগের দেয়া তথ্যমতে গতকাল নতুন বই এসেছে ৯৩টি। এর মধ্যে মেলায় আগামী প্রকাশনী এনেছে আবদুর রহমানের ‘মুক্তিযুদ্ধে কাজী সালাউদ্দিন বাহিনী’, প্রবীর চন্দ্রের ‘গ্রামীণ সংস্কৃতি ও সংকটের বেড়াজালে’, মঞ্জু সরকারের জীবনস্মৃতি ‘পথে নেমে পথ খোঁজা’ ও দাউদ হায়দারের ‘মিথ্যুকের সংহিতা’, অনন্যা এনেছে নাজরীন জেবিনের ‘দূরে কোথাও’ ও খোরশেদ আলমের ‘নীল কাঁকড়া’, টাঙ্গন এনেছে রঞ্জিত সরকারের ‘আÍরতি’, বিদ্যাপ্রকাশ এনেছে ধ্রুব এষের ‘আমাদের পরাবাস্তব টাইনের দিনরাত্রি’ ও মেজর ডা. খোসরোজ সামাদের ‘করোনা এখনো আতঙ্ক ও করণীয়’, সময় প্রকাশন এনেছে সুনীল সাহার ‘আমাদের স্মৃতির ভেলায় রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ’, ঐতিহ্য এনেছে অনীশ মণ্ডলের ‘একাত্তর : শৈশবে শরণার্থী’ ও অদিতি ফাল্গুনীর ‘ব্রাদার সিস্টার কাজী মাও সেতুং’, স্টুডেন্ট ওয়েজ এনেছে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়ালের স্মৃতিচারণামূলক গ্রন্থ ‘জীবনখাতার কয়েক পাতা’, অনিন্দ্য প্রকাশ এনেছে মোশতাক আহমেদের ‘নিতিনা’, বিভাস এনেছে মানিক চন্দ্র দের ‘ঘাটে ঘাটে খেয়াতরী’ (দ্বিতীয় খণ্ড) ও ‘বিদেশ ভ্রমণের গল্প’, পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স এনেছে সৈয়দ ইশতিয়াক রেজার ‘আপন আলাপ’, জোনাকি প্রকাশনী এনেছে সেলিনা হোসেনের ‘জাতিসত্তাভিত্তিক উপন্যাস’।
এদিন বইমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় ‘বাংলা সাহিত্যের অনুবাদ এবং বিদেশি সাহিত্যের বাংলা অনুবাদ’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন জিএইচ হাবীব এবং শামসুদ্দিন চৌধুরী। আলোচক ছিলেন সম্পদ বড়ুয়া, রফিক-উম-মুনীর চৌধুরী, অধ্যাপক মো. আবু জাফর এবং মাহবুবা রহমান। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন ফকরুল আলম।
প্রাবন্ধিকদ্বয় বলেন, ‘বহুকাল ধরেই সংস্কৃত, আরবি, ফারসি, ইংরেজি, হিস্পানিক, গ্রিক ও লাতিন বহু সাহিত্যের বাংলা অনুবাদ আমাদের পাঠের অভিজ্ঞতাকে সমৃদ্ধ করে আসছে। বাংলা ভাষায় অনুবাদ এবং বাংলা নানা রচনা বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদের ক্ষেত্রে ইংরেজি একটি উল্লেখযোগ্য স্থান দখল করে আছে। অথচ এখন পর্যন্ত আমাদের দেশে সাহিত্য অনুবাদকে যথাযথ মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করা যায়নি। যদিও বিদেশি সাহিত্যের অনুবাদ বিপুল পাঠকের চাহিদাকে পূরণ করে চলেছে। আড়ালে থেকেই অনুবাদ সাহিত্য জাতীয় সাহিত্যের পুষ্টি লাভে অপরিহার্য ভূমিকা রাখছে।’
আলোচকবৃন্দ বলেন, ‘আমাদের দেশে-বিদেশি সাহিত্যের বাংলা অনুবাদ যত হয়েছে সে তুলনায় বাংলাসাহিত্যের বিদেশি ভাষার অনুবাদ কম হয়েছে। তথাপি বাংলাসাহিত্যের ইতিহাস লেখা হলে সেখানে অনুবাদ-সাহিত্যও বিশেষ স্থান পাবার দাবি রাখে। দেশি অনুবাদকের পাশাপাশি বিদেশি অনুবাদকদেরও বাংলা ভাষার সাহিত্য বিদেশি ভাষায় অনুবাদের ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করতে হবে।’
সভাপতির বক্তব্যে ফকরুল আলম বলেন, ‘বাংলাসাহিত্যকে বিশ্বের দরবারে তুলে ধরার ক্ষেত্রে অনুবাদের কোনো বিকল্প নেই। এ জন্য দক্ষ অনুবাদক তৈরি করার জন্য আমাদের চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। পাশাপাশি অনূদিত গ্রন্থ বিদেশি পাঠকদের হাতে পৌঁছে দেয়ার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে।’
লেখক বলছি অনুষ্ঠানে নিজেদের নতুন বই নিয়ে আলোচনা করেন হাসান মাহমুদ, আফতাব হোসেন, মিনার মনসুর এবং আইরীন নিয়াজী মান্না। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে কবিতা পাঠ করেন ঝর্না রহমান, হাসান হাফিজ, হাসনাত লোকমান, মোশাররফ শরীফ, মাসুদ পথিক এবং শারমীন জাহান মিতু। আবৃত্তি পরিবেশন করেন আবৃত্তিশিল্পী আওরঙ্গজেব আরু, শিমুল পারভীন এবং পারভেজ চৌধুরী। ছিল সৈয়দ শরিফুল আলম শফুর পরিচালনায় সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘মাতৃভূমি’-এর পরিবেশনা। সংগীত পরিবেশন করেন খুরশিদ আলম, মুর্শিদুদ্দীন আহম্মদ, নবীন কিশোর, সঞ্জয় কুমার দাস, আঞ্জুমান আরা শিমুল, চম্পা বণিক।
অমর একুশে বইমেলার ১৫তম দিন (বুধবার) মেলা শুরু হবে বিকাল ৩টায়। চলবে একটানা রাত ৯টা পর্যন্ত। এদিন বিকাল ৪টায় বইমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হবে বাংলাদেশের লিটল ম্যাগাজিন শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন শহীদ ইকবাল। আলোচনায় অংশগ্রহণ করবেন হাফিজ রশিদ খান, অনিকেত শামীম এবং সরকার আশরাফ। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করবেন সাজ্জাদ আরেফিন।
নয়াশতাব্দী/এমএস
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ