নয়া শতাব্দী অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি।
ফেব্রুয়ারি এলেই উৎসবপ্রিয় বাঙালির উচ্ছ্বাস বেড়ে যায়। সবার মাঝেই দেখা দেয় দেশ, ভাষা ও স্বাধীনতার জন্য টান। নানা কারণে ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন সবাই। আর এর সূচনাটা হয় বাংলা একাডেমি আয়োজিত অমর একুশে বইমেলার মধ্য দিয়ে। তখন বাংলা একাডেমি ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যান হয়ে ওঠে সবার নতুন ঠিকানা। আড্ডা দেয়ার জন্য হোক আর প্রয়োজনীয় কাজের জন্য হোক কিংবা পরিবার-পরিজন নিয়ে বেড়ানোর জন্য হোক -এ স্থানটিকেই এ সময় বেছে নেন সবাই। প্রতিদিনই নানা বয়সি নানা মানুষের সমাগম পরিণত হয় এক মিলনমেলায়। এবারকার বইমেলার প্রথম দিন থেকেই লোক সমাগম বেড়েছে।
অমর একুশে বইমেলা এখন সর্বজনীন নতুন ঠিকানা। নির্ধারিত সময়ে মেলার দুয়ার খুলে দেয়ার পর ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে ভিড়। সন্ধ্যায় মেলার দুই প্রাঙ্গণ পরিণত হয় জনারণ্যে। প্রাথমিক নানা রকম ঝুট-ঝামেলা পেরিয়ে মেলার সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে প্রকাশনা সংস্থাগুলোর স্টলে তাকে তাকে এখন নতুন বই। সেসব বই থেকে বের হচ্ছে কাঁচা রঙের ঘ্রাণ। মেলা এবার আরও গোছাল। তাই মেলায় কোথাও কোনো হুড়োগুড়ি নেই। একা কিংবা দলবেঁধে মেলা ঘুরে বেড়াতে পারছেন নানা বয়সি পাঠক-ক্রেতা।
বইমেলার বয়স এখন ১৩ দিন। প্রকাশকরা বলছেন, ‘সামনে আরও জমে উঠবে মেলা। পাঠক-দর্শনার্থীরা এখন নতুন বইয়ের খোঁজ নিচ্ছেন। পছন্দের বইটি কিনেও নিচ্ছেন কেউ কেউ। অনেকে প্রিয় লেখকের কি কি বই আসছে এবং আগামীতে কি কি আসবে সে তালিকাও সংগ্রহ করছেন। বই কেনার চেয়ে মেলায় একটু ঘুরেফিরে বিকাল কিংবা সন্ধ্যাটি কাটিয়ে আসাই প্রধান উদ্দেশ্য বেশিরভাগেরই।’
প্রকাশনী সংস্থা আগামী প্রকাশনীর প্রধান নির্বাহী ওসমান গনি বলেন, ‘লোক সমাগম ভালো। আগামী দিনগুলো ভালো বিকিকিনি আশা করছি।’ শুক্র ও শনিবারের মতো রোববার (১২ ফেব্রুয়ারি) লোকারণ্য না হলেও জনসমাগম কম ছিল না। সন্ধ্যা হওয়ার পর থেকে মেলার প্রাঙ্গণজুড়ে নানা বয়সি মানুষের পদচারণায় মুখর। এদিনও বেচাকেনা হয়েছে ব্যাপক। এদিনও মেলাজুড়েই দেখা গেছে বইয়ের প্রকাশনা ঘিরে উৎসব আমেজ। বিভিন্ন স্টলের সামনেই লেখক ও তাদের আত্মীয় পরিজন, বন্ধুরা মিলে নতুন বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করেছেন। ছিল মিষ্টিমুখেরও আয়োজন।
অনিন্দ্য প্রকাশনীর প্রকাশক আফজাল হোসেন বলেন, ‘আশা করছি সত্যিকারের বিক্রি খুব শিগগিরই শুরু হবে।’ অন্বেষা প্রকাশনীর প্যাভিলিয়নে প্রকাশক শাহাদাত হোসেন বলেন, ‘মেলায় যারা আসছেন তারা সবাই বই কিনবেন এমনটা ভাবি না। তবে মানুষ যে বইয়ের টানে আসছেন, বই দেখছেন এটাও কম নয়। এখান থেকেই পাঠক সৃষ্টি হবে ও তারাও বই কিনবেন।’
ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশের অন্যতম প্রকাশক জহিরুল আবেদীন জুয়েল বলেন, ‘মেলা শুরুর পর থেকে পাঠক ও দর্শনার্থীদের ভালো সমাগম দেখছি। শেষদিকে বই বিক্রি বেশি হয়। তবে শুরুর দিক হিসেবে বিক্রি মোটামুটি ভালোই চলছে। পরিস্থিতি যা দেখছি, তাতে আশা জাগছে- এবার বই বিক্রি আগের তুলনায় বেশি হবে।’
বাংলা একাডেমির জনসংযোগ উপবিভাগের দেয়া তথ্যমতে মেলার ১২তম দিনে (রোববার) নতুন বই এসেছে ৭৯টি। বইমেলায় আগামী প্রকাশনী থেকে এসেছে শামীমা সুলতানার প্রবন্ধ ‘শেখ রেহানা : এক দীপ্ত শিখা’, ড. মো. জহুরুল ইসলাম এর ‘বঙ্গবন্ধুর আন্তর্জাতিক জোট রাজনীতি’ ও ড. ডি এম ফিরোজ শাহের ‘বঙ্গবন্ধু নদী নৌকা নারী’, নবান্ন প্রকাশনী এনেছে কবি মুহাম্মদ সামাদের কাব্যগ্রন্থ ‘শৃঙ্খল মুক্তির জন্য কবিতা’ ও রওশন জাহিদের লোকসংস্কৃতির বই ‘বাংলাদেশের লোকসংস্কৃতি : নারী ক্ষমতায়ন ও সামাজিক অবস্থান’, কথাপ্রকাশ থেকে মোশতাক আহমেদের কিশোর গোয়েন্দা উপন্যাস ‘নয়ন স্যার’, ঐতিহ্য থেকে মনজুরুল হকের রাজনীতি বিষয়ক গ্রন্থ ‘ইউক্রেন যুদ্ধ’, চয়ন প্রকাশনী এনেছে ডা. অরূপ রতন চৌধুরীর স্বাস্থ্যবিষয়ক বই ‘মুখ ও তাদের ৬০টি সমস্যা ও সমাধান’, পাঞ্জেরী পাবলিকেশনস এনেছে তানজিনা আক্তারের শিশুতোষ গল্প ‘বুদ্ধিমতী রাজকন্যা’, সন্দেশ প্রকাশনী এনেছে আব্দুল হান্নান ঠাকুরের ‘সারা জীবন’, অনুপম প্রকাশনী এনেছে স্বপন কুমার গায়েনের ‘শান্তির সৈনিক আইনস্টাইন’, কাব্যকথা এনেছে কবির সুমনের ‘বিন্দু’, পাঠক সমাবেশ এনেছে শেখ হাফিজুর রহমান কার্জনের ‘নন্দিত শৈশব এবং বাংলাদেশ কিশোর অপরাধ ও গ্যাং কালচার’, ভাষাচিত্র এনেছে গাজী মাজহারুল আনোয়ারের ‘অল্প কথার গল্প গান’ এবং ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশ এনেছে সবুজ ইউনুসের ‘মাল্টিমিডিয়া জার্নালিজম’।
বইমেলার মূলমঞ্চে ছিল ‘স্মরণ : হাসান হাফিজুর রহমান’ এবং ‘স্মরণ : হাবীবুল্লাহ সিরাজী’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন মিনার মনসুর এবং কাবেদুল ইসলাম। আলোচক ছিলেন শোয়াইব জিবরান, শাহাদাৎ হোসেন নিপু, রুবেল আনছার এবং ওবায়েদ আকাশ। সভাপতিত্ব করেন এএইচএম লোকমান।
প্রাবন্ধিকদ্বয় বলেন, ‘হাসান হাফিজুর রহমান সব বিচারেই এ দেশের বিরল প্রতিভাবানদের একজন। সাহিত্যের প্রায় সবকটি মাধ্যমেই রয়েছে তার প্রতিভা ও শ্রমের উজ্জ্বল ছাপ। তবে তার প্রধান পরিচয় তিনি কবি। একই সঙ্গে একজন কর্মীও বটে। দীর্ঘ তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে তিনি নিরলস কাজ করে গেছেন কবি ও কর্মীর দ্বৈত ভূমিকা। হাবীবুল্লাহ সিরাজী বাংলাদেশের সমকালীন কবিতার এক উল্লেখযোগ্য নাম। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাজীবন শেষে বিভিন্ন সময়ে দেশে-বিদেশে প্রকৌশলীর কার্যনির্বাহ করলেও পরিশীলিত মেধার মননে এবং আবেগমথিত হৃদয়বৃত্তির উৎসারণে তিনি ছিলেন আপাদমস্তক একজন কবি।’
আলোচকবৃন্দ বলেন, ‘হাসান হাফিজুর রহমান তার কবিতার মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধ পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সময়কে বাক্সময় করে উপস্থাপন করেছেন। তিনি একটি মুক্ত স্বাধীন-সুন্দর বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছেন এবং নিজেও সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের কঠিন সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধের দলিলপত্র সংকলনের মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজের জন্য তিনি আজীবন স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। ষাটের দশকের একজন গুরুত্বপূর্ণ কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী চিত্রকল্প, উপমা ও কাব্য ভাষায় নিজের একটি স্বতন্ত্র অবস্থান তৈরি করে নিয়েছিলেন। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন পেশায় নিযুক্ত থাকলেও নিরীক্ষাপ্রবণ এই কবি স্বীয় হৃদয়-মননের মূল খোরাক তথা কাব্য রচনায় কখনও ক্ষান্ত দেননি।’
সভাপতির বক্তব্যে এএইচএম লোকমান বলেন, ‘বাংলাসাহিত্যের আকাশে উজ্জ্বল দুই নক্ষত্রের নাম হাসান হাফিজুর রহমান এবং হাবীবুল্লাহ্ সিরাজী। তারা তাদের জীবন, সৃষ্টিকর্ম ও আদর্শ দিয়ে আমাদের কাছে প্রাতঃস্মরণীয় হয়ে আছেন এবং থাকবেন।’
লেখক বলছি অনুষ্ঠানে নিজেদের নতুন বই নিয়ে আলোচনা করেন রকিবুল হাসান, রাহাত মিনহাজ, ফেরদৌস নাহার এবং আশিক মুস্তাফা। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে কবিতা পাঠ করেন বদরুল হায়দার, টোকন ঠাকুর, খাতুনে জান্নাত, আহসান মালেক এবং কাজী আনিসুল হক। আবৃত্তি পরিবেশন করেন আবৃত্তিশিল্পী শিরি জাহান, মীর মাসরুর জামান রনি এবং অনিমেষ কর। ছিল শরণ বড়ুয়ার পরিচালনায় গীতি আলেখ্য ‘প্রশিকা মানবিক উন্নয়ন কেন্দ্র’, কবিরুল ইসলাম রতনের পরিচালনায় নৃত্য সংগঠন ‘নৃত্যালোক’ এবং ইকবাল হাফিজের পরিচালনায় শিশু-কিশোর সংগঠন ‘দুনিয়া সবুজ কুঁড়ি কচি কাঁচার মেলা’-এর পরিবেশনা। সংগীত পরিবেশন করেন ফারহানা ফেরদৌসী তানিয়া, রাজিয়া সুলতানা, মো. মেজবাহ রানা, আবুল কালাম আজাদ, নাফিসা ইসলাম ফাইজা, সুমন চন্দ্র দাস, সুজন হাওলাদার।
১৩তম দিন (সোমবার) মেলা শুরু হবে বিকাল ৩টায়। চলবে একটানা রাত ৯টা পর্যন্ত। এদিন বিকাল ৪টায় বইমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হবে ‘স্মরণ : আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন মফিদুল হক। আলোচনায় অংশগ্রহণ করবেন মোনায়েক সরকার, হারিসুল হক এবং অপূর্ব শর্মা। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করবেন আবেদ খান।
নয়াশতাব্দী/এমএস
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ