নয়া শতাব্দী অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি।
দিন যত যাচ্ছে, জমে উঠছে অমর একুশে বইমেলা। ২৮ দিনের এ মেলা ঘিরে সপ্তাহের প্রতি শুক্র ও শনিবার থাকছে ‘শিশু প্রহর’। মেলার সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে তৈরি করা হয়েছে অস্থায়ী শিশু চত্বর।
শনিবার (১১ ফেব্রুয়ারি) ছিল এবারকার মেলার চতুর্থ শিশুপ্রহর। এদিনও নেচে গেয়ে সিসিমপুর অনুষ্ঠান উদযাপন করেছে শিশুরা। শিশু চত্বরে এ আয়োজন উপভোগ করতে আসে কয়েকশ শিশু। শিশু চত্বরে আনন্দে মেতে ওঠে কোমলমতি শিশুরা। পাশে দাঁড়িয়ে সেই আনন্দ উপভোগ করেন অভিভাবকরাও।
আনন্দের ছলে শেখার জন্য টুকটুকি, হালুম, ইকরি আর শিকুদের সঙ্গে দর্শক হয়ে যায় মেলায় আসা শিশুরা। ছন্দে-সুরে, ছড়া-গানে সিসিমপুরের এসব চরিত্রগুলোর মাধ্যমে বাচ্চাদের জন্য নানা শিক্ষণীয় বিষয় পরিবেশনায় তুলে ধরা হয়।
আদাবর থেকে আসা শিশু জাফরিন বলে, ‘টুকটুকি, হালুমদের দেখেছি। সিসিমপুরের অনুষ্ঠান দেখে ভালো লাগছে।’ মেলায় আসা শিশু আরাফ বিন সাদেক বলে, ‘অনেক মজা করেছি। সিসিমপুরের বন্ধুদের দেখেছি। তাদের সঙ্গে নেচেছি।’ শিশু প্রহরে মেয়েকে নিয়ে আসা ছন্দা রায় বলেন, ‘প্রতিদিন অফিস করতে হয়। মেয়েকে নিয়ে তেমন ঘুরতে যেতে পারি না। ছুটির দিনে বইমেলায় মেয়েকে নিয়ে এসেছি যেন একটু আনন্দ পায়। ভালো লেগেছে। মেয়েকে নিয়ে মেলায় ঘুরব, বই কিনব।’
বইমেলায় ছেলেকে নিয়ে আসা অভিভাবক মিনহাজুল আবেদিন বলেন, ‘ছেলেকে নিয়ে বইমেলায় এলাম। এসে দেখি সিসিমপুর চলছে। ভালোই হলো সিসিমপুরটা দেখাতে পেরে। ও অনেক আনন্দ পেয়েছে। বইমেলা ঘুরে দেখব, ছেলেকে বই কিনে দেব।’
সিসিমপুরের সমন্বয়ক সাব্বির বলেন, ‘প্রতি শুক্র ও শনিবার সিসিমপুরের এ আয়োজন মেলার শেষ শনিবার পর্যন্ত থাকবে। শিশুদের আনন্দ দিতেই আমাদের এ আয়োজন।’
দুপুর ১২টা। বাবা-মায়ের হাত ধরে এসেছে আর্শনা হাবি। মা-বাবা দুজনের হাতেই আর্শনার আবদারে কেনা বই। ছোটদের মজার মজার ধাঁধা, বিজ্ঞানের বিস্ময় ও আবিষ্কারের গল্প, ভুতুড়ে দুর্গ, অ্যারাউন্ড দ্য ওয়ার্ল্ড ইন এইটি ডেজ, ছোটদের বিজ্ঞানের খেলা, টোনাটুনির ম্যাজিক অ্যান্ড কালারিং বুকসহ আরও বেশ কিছু বই। এসব পেয়ে খুশিতে আপ্লুত আর্শনা। শিশুপ্রহরে আর্শনার মতো সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে শিশু চত্বরে ভিড় করেছিল আরও অনেক শিশু। তারা ছবি আঁকে, গান গায়।
এ ভিড়ে শিশুদের কোলাহলে আর্শনার মা রাহিমা খাতুন বললেন, ‘গত দুই বছর ধরে বাচ্চারা অনেকটাই ছিল ঘরবন্দি, করোনাকাল চলে যাওয়ার পর কবে আগের মতো বইমেলা হবে এমন প্রতীক্ষায় ছিলাম। আজ এসে মনটা ভরে গেল। শীতের সকালে মিষ্টি পরিবেশে বাচ্চাদের নিয়ে এদিক সেদিক ঘুরতে পারছি।’
সকালে বাংলা একাডেমির আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ মিলনায়তনে শিশু-কিশোর সংগীত প্রতিযোগিতার প্রাথমিক বাছাই পর্ব অনুষ্ঠিত হয়। এতে প্রায় ২০০ শতাধিক প্রতিযোগী অংশ নেয়।
সরেজমিন দেখা যায়, অন্যপ্রকাশ, শব্দশৈলী, পাঞ্জেরী, তাম্রলিপি, অনন্যা, ঐতিহ্য, বাতিঘর, অ্যাডর্ন, বেঙ্গল পাবলিশার্স, মাওলা ব্রাদার্স, প্রথমাসহ বিভিন্ন স্টলে ছিল বইপ্রেমীদের উপচেপড়া ভিড়। এসব স্টলে পছন্দের লেখককে ঘিরে দেখা গেছে সেলফি তোলার হিড়িক। বিক্রেতারাও ব্যস্ত ছিলেন বই বিক্রিতে। বিক্রেতারা জানান, ‘মেলায় আসা বেশিরভাগ দর্শনার্থীই বিভিন্ন স্টল ঘুরে ঘুরে বইয়ের মলাট উল্টেপাল্টে দেখেছেন আর নতুন নতুন বইয়ের খোঁজ নিয়েছেন, জেনেছেন দামও। তবে দিন অতিবাহিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বেচাবিক্রিও বেড়েছে বহুগুণ।’
সময় প্রকাশনের বিক্রয়কর্মী জাফর বলেন, ‘আশা করছি সামনে আরও বাড়বে। মানুষ আসুন, বই কিনুন, এটাই আমাদের প্রত্যাশা।’
বাংলা একাডেমির জনসংযোগ উপবিভাগের দেয়া তথ্যমেলার ১১তম দিনে শনিবার (১১ ফেব্রুয়ারি) নতুন বই এসেছে ১৯১টি। মেলায় এরই মধ্যে এসেছে বিদ্যাপ্রকাশ থেকে মোহিত কামালের উপন্যাস ‘কার্তিকে বসন্ত’, চন্দ্রাবতী থেকে খান মাহবুবের ভ্রমণ উপন্যাস ‘দেখতে দেখতে বহুদূরে’, আগামী থেকে এসেছে মোনায়েম সরকার সম্পাদিত ‘আবদুল গাফফার চৌধুরী স্মারক গ্রন্থ’, রফিকুর রশীদের ‘শেখ মুজিব শেখ রাসেল ছেলেবেলার গল্প’, ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেনের প্রবন্ধ ‘বঙ্গবন্ধু-পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও কূটনীতি’, লীনা তাপসী খানের ‘কাজী নজরুল ইসলামের সংগীত ভাবনা’, অনন্যা থেকে হানিফ সংকেতের ‘আবেগ যখন বিবেকহীন’। ইউপিএল এনেছে রেহমান সোবহানের ‘আনট্রাঙ্কুইল রিকালেকশন : ফ্রম ডন টু ডার্কনেস’, প্রথমা এনেছে মহিউদ্দিন আহমদের ‘বিএনপি : সময়, অসময়’, আবদুল মান্নান সৈয়দের ‘আমার নজরুল’, আনোয়ারা সৈয়দ হকের ‘দেখে এলাম মিশর ও মরক্কো’, মঈন আহমেদের ‘যাত্রাতিহাস’, আবিদ আজাদের ‘কবিতার স্বপ্ন’ এনেছে ঐতিহ্য, মুনতাসীর মামুনের ‘আদর্শ, রাষ্ট্র, রাজনীতি’ এনেছে মাওলা ব্রাদার্স, কথাপ্রকাশ থেকে প্রকাশ হয়েছে সৈয়দ বদরুল আহসানের ‘স্টার লাইট’, আনিসুল হকের ‘প্রেরণার গল্প’ হাসান আজিজুল হকের ‘নাম গোত্রহীন’ প্রকাশ করেছে ইত্যাদি, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর ‘স্বপ্ন ছিল, থাকবেও’ প্রকাশ করেছে বাতিঘর, দেবারতী মুখোপাধ্যায়ের ‘ঈশ্বরের অন্তিম শ্বাস’ এনেছে অন্যধারা, মোশতাক আহমেদের ‘ছায়া আত্মা’ প্রকাশ করেছে অনিন্দ্য প্রকাশ, মনজুর রহমান শান্তর ‘প্রাচীন গ্রিক দার্শনিক সক্রেটিস’ গ্রন্থটি প্রকাশ করেছে রোদেলা, আলী ইমামের ‘কল্প বিজ্ঞানের রোমাঞ্চকর ভুবনে’ বইটি এনেছে মুক্তধারা, ফরহাদ আহমেদের ‘জন্মদাগ’ প্রকাশ করেছে চয়ন, কামরুল হাসানের ‘নজিরের অগ্রপথিক’ এনেছে টুম্পা, হাবিবুর রহমানের ‘চিঠিপত্র : শেখ মুজিবুর রহমান’ প্রকাশ করেছে পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স, জহির খানের ‘আগুন চোখের মেয়ে’ বই প্রকাশ করেছে আহমদ পাবলিশিং হাউস, আবদুল মান্নান সৈয়দের প্রবন্ধ ‘বাংলা সাহিত্যে মুসলমান’ বই পাওয়া যাচ্ছে অবসরের প্যাভিলিয়নে।
বইমেলার মূলমঞ্চে ছিল ‘স্মরণ : আশরাফ সিদ্দিকী’ এবং ‘স্মরণ সাঈদ আহমদ’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। এতে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ইয়াসমিন আরা সাথী এবং মাহফুজা হিলালী। আলোচক ছিলেন উদয়শংকর বিশ্বাস, শামস আল দীন, রীপা রায় এবং আব্দুল হালিম প্রামাণিক। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন খুরশীদা বেগম।
প্রাবন্ধিকদ্বয় বলেন, ‘ড. আশরাফ সিদ্দিকী ছিলেন প্রথিতযশা লোকসংস্কৃতি সংগ্রাহক এবং বিশ্লেষক। তিনি বাংলাদেশ তথা উপমহাদেশের ফোকলোর চর্চায় ভিন্নতার অনুসন্ধান করেছেন। ফোকলোরের নানা অনুষঙ্গ বিজ্ঞানসম্মতভাবে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের মাধ্যমে জনসম্মুখে প্রকাশ করেছেন। সাঈদ আহমদ ছিলেন বাঙালি হয়েও একজন বিশ্বমানব। বাংলা এবং ভারতীয় সংস্কৃতি তো বটেই বিশ্বের প্রতিটি দেশের সংস্কৃতির প্রতি ছিল তার প্রবল আগ্রহ। তার সব থেকে বড় অবদান, তিনি বিদেশি সাহিত্য আঙ্গিককে দেশে এনেছিলেন এবং দেশের সাহিত্য-শিল্প-সংস্কৃতিকে বিশ্বের কাছে পৌঁছে দিয়েছিলেন।’
আলোচকবৃন্দ বলেন, ‘বাংলাদেশে যারা ফোকলোর চর্চায় উচ্চ শিক্ষাগ্রহণ করেছিলেন আশরাফ সিদ্দিকী তাদের মধ্যে একজন। ফোকলোর গবেষণায় কিংবদন্তি, লোককাহিনি ও উৎসব-আচার সম্পর্কে তার বিস্তর আগ্রহ ছিল। তিনি কেবল লোকসংস্কৃতি গবেষকই ছিলেন না, বাংলাসাহিত্যের জীবনঘনিষ্ঠ ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, নাট্যকার, কবি, প্রাবন্ধিক, শিশুসাহিত্যিক এবং শিক্ষাবিদও ছিলেন। অন্যদিকে বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী সাঈদ আহমদ এ দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে এক অনন্য নাম। চাকরির সুবাদে তিনি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ভ্রমণ করেছেন এবং বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে বিশ্বসংস্কৃতির মেলবন্ধ ঘটিয়েছেন।’
সভাপতির বক্তব্যে খুরশীদা বেগম বলেন, ‘বাংলাদেশের সাহিত্য ও সংস্কৃতি জগতের বরেণ্য দু’জন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ড. আশরাফ সিদ্দিকী এবং সাঈদ আহমদ। তাদের জীবন, কর্ম ও আদর্শ আমাদের তরুণ সমাজকে পথ দেখাবে। এ গুণী ব্যক্তিদের স্মরণ করা আমাদের জন্য একান্ত জরুরি।’
লেখক বলছি অনুষ্ঠানে নিজেদের নতুন বই নিয়ে আলোচনা করেন মুর্শিদা বিনতে রহমান, রমজান মাহমুদ, ইশরাত তানিয়া এবং কবির কল্লোল। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে কবিতা পাঠ করেন হারিসুল হক, রিশাদ হুদা, শেলী সেলিনা, আসাদউল্লাহ এবং জরিনা আখতার। আবৃত্তি পরিবেশন করেন গোলাম সারোয়ার, মাসকুরে সাত্তার, বেলায়েত হোসেন এবং সায়েরা হাবীব।
ছিল জাহাঙ্গীর চৌধুরীর পরিচালনায় আবৃত্তি সংগঠন ‘উদ্ভাস আবৃত্তি সংগঠন’ এবং অমিত হিমেলের পরিচালনায় সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘সমস্বর’-এর পরিবেশনা। সংগীত পরিবেশন করেন রওশন আলম, অনাবিল ইহসান, মামুনুল হক সিদ্দীক, জুলি শারমিলী, ফারহানা আক্তার, রবিউল হক, আরতি রানি সেন এবং জয় চক্রবর্তী।
অমর একুশে বইমেলার ১২তম দিন রোববার (১২ ফেব্রুয়ারি) মেলা দ্বার খুলে হবে বিকাল ৩টায়। চলবে একটানা রাত ৯টা পর্যন্ত। এদিন বিকাল ৪টায় বইমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হবে ‘স্মরণ : হাসান হাফিজুর রহমান’ এবং ‘স্মরণ : হাবীবুল্লাহ সিরাজী’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন মিনার মনসুর এবং শেখ মোহাম্মদ কাবেদুল ইসলাম। আলোচনায় অংশ নেবেন শোয়াইব জিবরান, শাহাদাৎ হোসেন নিপু, রুবেল আনছার এবং ওবায়েদ।
নয়াশতাব্দী/এমএস
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ