বুধবার, ২২ মার্চ ২০২৩, ৮ চৈত্র ১৪৩০
প্লেজার ট্যুর ও স্বর্ণ চোরাচালান

চার বছরে কোটিপতি আরাভ

প্রকাশনার সময়: ১৮ মার্চ ২০২৩, ০৯:৫৯

মাত্র চার বছরেই বিপুল অর্থবিত্তের মালিক বনে গেছেন বহুল আলোচিত আরাভ খান। পুলিশি তদন্তে অর্থবিত্ত অর্জনের পদ্ধতি নিয়ে পাওয়া যাচ্ছে চাঞ্চল্যকর তথ্য।

তদন্তসংশ্লিষ্টরা বলছেন, মূলত শোবিজ তারকা ও শিল্পপতিদের বিদেশে নিরিবিলি সময় কাটানোর মধ্যস্থতা করে বিপুল অর্থের মালিক বনে গেছে ‘আরাভ সিন্ডিকেট’। এসব প্লেজার ট্যুরের চিত্র গোপনে ধারণ করে করা হতো ব্লাকমেইল। তার ব্লাকমেইলিং কর্মকাণ্ডের অন্যতম সহযোগী মডেল ‘পিয়াসা সিন্ডিকেট’। এ বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী পেয়েছে চাঞ্চল্যকর তথ্য।

তদন্তসংশ্লিষ্টদের দেয়া তথ্যমতে— শোবিজ তারকাদের সঙ্গে সখ্যকে পুঁজি করে ‘রাতের রানিখ্যাত’ মডেল পিয়াসার এসব কর্মকাণ্ডের সঙ্গে আরাভের কর্মকাণ্ডের মিল রয়েছে। পিয়াসা সিন্ডিকেটের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন নজরুল রাজ, আরাভ ও মিশু। তদন্তে ব্লাকমেইলিং ও পুলিশ কর্মকর্তা খুনের বিষয়টি তদন্তে উঠে আসে।

গোয়েন্দা পুলিশের দেয়া তথ্যমতে— দুবাইয়ে বসবাসরত রবিউল ইসলাম আপন ওরফে আরাভকে দেশে ফিরিয়ে আনতে তোড়জোড় চলছে পুলিশে। দেশে থাকাকালীন আন্ডারওয়ার্ল্ডের শীর্ষ সন্ত্রাসীদের সঙ্গে ছিল তার নিবিড় সম্পর্ক। পাশাপাশি গুলশান ও বনানী এলাকার নামিদামি কিছু ব্যবসায়ী ও মডেলের সঙ্গেও ছিল তার সখ্য ও ওঠাবসা। ২০১৮ সালে পুলিশ কর্মকর্তা মামুন ইমরান খান হত্যাকাণ্ডের পর আরেক আলোচিত মডেল পিয়াসা ও নজরুল রাজের সঙ্গে আঁতাত করে স্বর্ণ চোরাচালানে জড়িয়ে পড়েন বলে পুলিশের কাছে তথ্য এসেছে। দুবাইয়ে গড়ে তোলেন স্বর্ণের জমজমাট ব্যবসা। প্রতিনিয়ত পেয়েছেন কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তার আস্কারা। মামলা থেকে রেহাই পেতে নিজের নাম পরিবর্তন করে ছদ্মনাম ব্যবহার করেন। আর এসবের কারণে অল্প সময়ে হয়ে যান ধনাঢ্য ব্যক্তিতে।

পুলিশ, ব্যবসায়ী ও মডেলরা দুবাইতে গেলে তার সান্নিধ্য পেতেন। স্বর্ণের দোকান উদ্বোধন হওয়ার পর জাতীয় দলের তারকা ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান দেশে চলে এলেও অন্য অতিথিরা রয়ে গেছেন দুবাইয়ে। এরই মধ্যে আরাভের সহযোগীদের তালিকা তৈরি করেছে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা।

আরাভকে দেশে ফিরিয়ে আনতে গতকাল শুক্রবার পুলিশ সদর দফতর থেকে ইন্টারপোলে চিঠি দেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশের একটি সূত্র। তার বিরুদ্ধে ১২টি ওয়ারেন্ট জারি করা আছে। গ্রেফতার এড়াতে আরাভ কানাডা বা আমেরিকায় আত্মগোপনে চলে যেতে পারেন বলে মনে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন দুবাইয়ের ব্যবসায়ীরা। দুবাইয়ে তার ৮টি ফ্ল্যাট আছে। কানাডা ও আমেরিকায়ও আছে ফ্ল্যাট।

বৃহস্পতিবার ফেসবুক লাইভে এসে কথা বলেন আরাভ। ২২ মিনিট ১৪ সেকেন্ড কথা বলেন তিনি। আরাভ নিজেকে নির্দোষ দাবি করে বলেন, ‘আমি পুলিশ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে কখনও জড়িত ছিলাম না। কিছুদিন আগে বাংলাদেশের এক সাংবাদিক ৫ কোটি টাকা চেয়েছিলেন। ওই টাকা না দেয়ায় তারা সংবাদ প্রকাশ করবে বলে জানিয়েছিলেন। আমি জীবনে কাউকে একটা চড় মারিনি। যে কেস, সেটি সত্যি। কিন্তু আমি এর সঙ্গে জড়িত ছিলাম না। আমাকে ফাঁসানো হয়েছে। আমার দোষ শুধু ওই অফিসটা ছিল আমার। আমার মনে কোনো দুর্বলতা নেই। কোর্টের রায়ের জন্য অপেক্ষা করেন। দেখেন আমি অপরাধী কিনা। যদি আদালতের বিচারে আমি অপরাধী হই, তাহলে সাজা মাথা পেতে নেব।’

জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) হারুন অর রশীদ বলেন, ‘পুলিশ কর্মকর্তা মামুন হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে আরাভ জড়িত। তিনি চার্জশিটভুক্ত আসামি। তার ফেসবুকে নিজেই স্বীকার করেছেন লাশ গুম করার সঙ্গে তিনি জড়িত। এই থেকে প্রমাণ হয়েছে আরাভ কী ধরনের অপরাধ করেছেন। তাকে দেশে ফিরিয়ে আনতে সব ধরনের প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে।’

পুলিশ সূত্র জানায়, আন্ডারওয়ার্ল্ডের শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসান ও জয় ছিলেন তার অন্যতম সহযোদ্ধা। তাদের মাধ্যমে গুলশান ও বনানী এলাকার নামিদামি মডেলদের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। পাশাপাশি কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তা ও দুই শীর্ষ ব্যবসায়ীর আস্কারা পেয়েছেন সবচেয়ে বেশি। মূলত তাদের মাধ্যমে আরাভ বেপরোয়া হয়ে ওঠেন।

রিয়েল এস্টেট ব্যবসার পাশাপাশি স্বর্ণ চোরাচালানেও জড়িয়ে পড়েন। যার সুবাদে দুবাইয়ে গড়ে তোলেন আলিশান স্বর্ণের দোকান। ওই দোকানের ব্যবসায়িক পার্টনার পুলিশের দুই সাবেক কর্মকর্তা ও দুই শীর্ষ ব্যবসায়ী। ওই ব্যবসায়ীরা গুলশান ও বনানী এলাকার পরিচিত। আলোচিত মডেল পিয়াসা ও নজরুল রাজের সঙ্গেও তার আছে সুসম্পর্ক।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে গুলশান এলাকার কয়েকজন ব্যবসায়ী বলেন, পুলিশ কর্মকর্তাকে হত্যা করার সময় আরাভসহ বেশ কয়েকজন রাঘববোয়াল জড়িত। পিয়াসা ও রাজ হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে বহু কিছু জানেন। তারা আরাভের সঙ্গে দেখা করতে নিয়মিত দুবাই যান। রাজ বর্তমানে দুবাই অবস্থান করছেন। পিয়াসাও কিছুদিন আগে সেখানে গিয়েছেন বলে আমরা জানি।

ওই ব্যবসায়ীরা আরও বলেন, ২০২১ সালের ২ আগস্ট রাতে হঠাৎ করে ডিবির পুলিশের একাধিক টিম রাজধানীর বারিধারায় মডেল পিয়াসার বাসায় অভিযান চালায়। এ সময় বিপুল পরিমাণ মাদকদ্রব্যসহ পিয়াসাকে গ্রেফতার করা হয়। পাশাপাশি রাজকেও গ্রেফতার করে পুলিশ। সমাজের উঠতি বয়সি ছেলেমেয়েদের তাদের বাসায় মাদক সেবনের ব্যবস্থা করে দিতেন তারা।

পরে ওইসব ছেলেমেয়েদের সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের আপত্তিকর ছবি উঠাতেন। আর এসব ছবি দিয়ে শিল্পপতি বাবা-মা-আত্মীয়স্বজনদের ব্ল্যাকমেইল করেন। পিয়াসা ও রাজকে জামিনে কারাগার থেকে বের করে আনার পেছনে আরাভ মোটা অঙ্কের অর্থ ব্যয় করেছিলেন।

পুলিশ সদর দফতরের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, ‘আরাভ ঠান্ডা মাথার ক্রিমিনাল। স্বর্ণ চোরাচালান করেই কয়েকশ কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। দুবাইয়ে আরাভের স্বর্ণ দোকান উদ্বোধন করতে সাকিবের যাওয়া ঠিক হয়নি। অর্থের প্রয়োজন সবারই আছে। তবে সাকিবের মতো তারকার টাকার পেছনে ছোটা খুবই দুঃখজনক। আশা করি সামনের দিনগুলোতে সাকিব বুঝেশুনে পা বাড়াবেন। তারপরও সাকিব ও হিরো আলমকে জিজ্ঞাবাদ করা হবে।’

তিনি বলেন, ‘আলোচিত মডেল পিয়াসা ও নজরুল রাজের সঙ্গেও আরাভের ভালো সম্পর্ক আছে। ব্যবসায়ী ও পুলিশে যাদের সঙ্গে তার সম্পর্ক আছে প্রয়োজনে তাদেরও জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। আরাভকে দেশে ফিরিয়ে আনতে ইন্টারপোলকে চিঠি পাঠান হয়েছে। আশা করি দ্রুত সময়ের মধ্যে তাকে দেশে আনা সম্ভব হবে।’

বনানীর একটি ফ্ল্যাটে জন্মদিনের দাওয়াতে গিয়ে খুন হন এসবির কর্মকর্তা মামুন ইমরান খান। গুম করতে লাশ গাড়িতে করে নেয়া হয় গাজীপুরের কালীগঞ্জের একটি জঙ্গলে। সেখানে লাশে পেট্রোল ঢেলে আগুনে ঝলসিয়ে দেয়া হয় মুখমণ্ডল। আরাভের বিরুদ্ধে এ পর্যন্ত ১২টি ওয়ারেন্ট আছে।

দুবাইয়ে অবস্থান করা এক ব্যবসায়ী টেলিফোনে জানান, ‘আরাভ জুয়েলার্সে অন্তত ৫০০ কোটি টাকার স্বর্ণ আছে। জাতীয় দলের তারকা ক্রিকেটার সাকিবকে নেয়ার উদ্দেশ্য হলো আরাভ লাইম লাইটে আসা। আর আরাভের বিষয়ে সাকিব ও হিরো আলম সবকিছুই জানতেন। দোকানের লোগো বানাতেই খরচ হয়েছে ৪২ কোটি টাকা। আরাভ মাস ছয়েক আগে দুবাইয়ের বুর্জ খলিফা টাওয়ারে একটি আলিশান ফ্ল্যাট কিনেছেন।

দুবাইয়ে তার নামে সাতটি ফ্ল্যাট আছে। তার আচার-ব্যবহার কিন্তু খুবই ভালো। অল্প সময়ে সবাইকে আপন করে নেন। এক সময় আরাভের অবস্থা ভালো ছিল না। গুলশান ও বনানী এলাকার কিছু ব্যবসায়ী ও মডেল প্রায়ই আসেন আরাভের কাছে। আরাভ জুয়েলার্সের ব্যবসায়িক পার্টনার দুইজন পুলিশ কর্মকর্তা ও দুই ব্যবসায়ী। লেখাপড়া বেশি না থাকলেও অনর্গল ইংরেজিতে কথা বলেন। কানাডা ও আমেরিকার নাগরিকও আরাভ। ভারতের পাসপোর্টে আরাভ দুবাই আসেন।

তিনি আরও বলেন, আরাভের বিরুদ্ধে সংবাদ প্রকাশ হওয়ার পর তিনি অনেকটা পর্দার আড়ালে চলে গেছেন। তার ঘনিষ্ঠরা বলাবলি করছেন যে কোনো সময় তিনি কানাডা বা আমেরিকায় চলে যাবেন। আমাদেরও আশঙ্কা তিনি দুবাই থাকবেন না। পরিস্থিতি ঠান্ডা হলে হয়তো দুবাই আসবেন। যদিও আরাভ বলছেন, তিনি বাংলাদেশে গিয়ে পুলিশকে সহায়তা করবেন। ২০২১ সালের ৩১ অক্টোবর আরব আমিরাত সরকার তাকে রেসিডেন্ট পারমিট দিয়েছে।

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ