নয়া শতাব্দী অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি।
শুধু বাঙালি নয়, বিশ্বের প্রতিটি জাতির মাতৃভাষার মর্যাদা, স্বাধিকার, স্বাধীনতা ও মানুষের মতো বাঁচার দাবির সংগ্রামের দুর্জয় অনুপ্রেরণা সৃষ্টির চির অনির্বাণ শিখার দীপ্তিতে দিগন্ত উদ্ভাসিত করেছে ভাষা আন্দোলন। ভাষা আন্দোলন মানুষকে শিখিয়েছে আত্মত্যাগের মন্ত্র, বাঙালিকে করেছে মহীয়ান। এ আন্দোলনের পথ ধরেই এসেছে মহত্তর স্বাধীনতার চেতনা।
‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান লিখেছেন, “আমরা দেখলাম, বিরাট ষড়যন্ত্র চলছে বাংলাকে বাদ দিয়ে রাষ্ট্রভাষা উর্দু করার। পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ এবং তমদ্দুন মজলিশ এর প্রতিবাদ করল এবং দাবি করল, বাংলা ও উর্দু দুই ভাষাকেই রাষ্ট্রভাষা করতে হবে। আমরা সভা করে প্রতিবাদ শুরু করলাম। এ সময় পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ এবং তমদ্দুন মজলিশ যুক্তভাবে সর্বদলীয় সভা আহ্বান করে একটা ‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন করল। সভায় ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চকে ‘বাংলা ভাষা দাবি’ দিবস ঘোষণা করা হলো। জেলায় জেলায় আমরা বের হয়ে পড়লাম।” (পৃষ্ঠা-৯১, ৯২)। ’৪৮-এর ১১ মার্চ অন্যতম রাষ্ট্রভাষার দাবিতে বাংলার ছাত্রসমাজ প্রথম প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করে। সেদিন যারা মাতৃভাষার দাবিতে রাজপথে সংগ্রাম করে কারাবরণ করেন শেখ মুজিবুর রহমান এবং শামসুল হক ছিলেন তাদের অন্যতম। মার্চের ১১ থেকে ১৫-এই পাঁচ দিন কারারুদ্ধ ছিলেন নেতারা।
পাঁচ দিনের কারাজীবনের স্মৃতিতর্পণ করে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, “দেওয়ালের বাইরেই মুসলিম গার্লস স্কুল। যে পাঁচ দিন আমরা জেলে ছিলাম সকাল দশটায় মেয়েরা স্কুলের ছাদে উঠে স্লোগান দিতে শুরু করত, আর চারটায় শেষ করত। ছোট্ট ছোট্ট মেয়েরা একটু ক্লান্তও হতো না। ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই,’ ‘বন্দি ভাইদের মুক্তি চাই,’ ‘পুলিশি জুলুম চলবে না’— নানা ধরনের স্লোগান। এই সময় শামসুল হক সাহেবকে আমি বললাম, হক সাহেব ঐ দেখুন, আমাদের বোনেরা বেরিয়ে এসেছে। আর বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা না করে পারবে না। হক সাহেব আমাকে বললেন, ‘তুমি ঠিকই বলেছ, মুজিব’।
জাতীয় ইতিহাসে প্রথম ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক আন্দোলন ছিল ভাষা আন্দোলন। এ আন্দোলন রূপলাভ করে ১৯৪৮ সালে, সদ্য স্বাধীন রাষ্ট্র পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল কায়েদ-ই-আজম যখন ঢাকায় এসে ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ করেছিলেন! ২১ মার্চ তারিখে রেসকোর্স ময়দানে ও ২৪ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন— উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। সঙ্গে সঙ্গেই নির্ভীক যুবকণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছিল ‘না’ ‘না’ ধ্বনি। ভাষার দাবিতে শুরু হয়ে যায় বাঙালির মরণপণ সংগ্রাম। সেদিন প্রত্যেক বাঙালির কাছে ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ ছিল বীজমন্ত্র স্বরূপ। দেশের সাধারণ মানুষও বুঝে গিয়েছিল— পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী মুখের ভাষা কেড়ে নিতে চায়। বাঙালিদের কাছে ‘মা’ ও মায়ের মুখের ভাষা ‘বাংলা’ দুই-ই সমান পবিত্র। বাংলা ভাষা ও বাঙালি সত্তায় পূর্ববাংলার সমগ্র বাঙালি অভিন্ন চেতনায় ও অভিন্ন অনুভূতিতে একাত্ম।
সময়ের আবর্তে খাজা নাজিমউদ্দিন হয়ে গেলেন সে সময়ে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী। নূরুল আমিন হলেন পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিন আসেন পূর্ব পাকিস্তান সফরে। ক্ষমতালোভী নাজিমউদ্দিন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর চেয়ারে বসে সব ভুলে গেলেন, তিনি ১৯৫২ সালের ২৬ জানুয়ারি পল্টনের এক জনসভায় পুনর্ব্যক্ত করলেন— উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। এ বক্তব্য পূর্ববাংলার জনগণের মনে অসন্তোষ আরও সংহত হলো, প্রদেশজুড়ে উঠল প্রতিবাদ। অথচ এ খাজা নাজিমউদ্দিন ১৯৪৮ সালের ১৫ মার্চ পূর্ব পাকিস্তানের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী থাকা অবস্থায় ‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’-এর সঙ্গে ভাষার দাবির শর্ত মেনে চুক্তিবদ্ধ হয়েছিলেন। ক্ষমতার এমনই মোহ— প্রধানমন্ত্রী হয়ে তিনি তার প্রতিশ্রুতি ভাঙলেন, বিশ্বাসঘাতকতা করলেন বাঙালিদের সঙ্গে, বাংলা ভাষার সঙ্গে। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন আরও বেগবান হলো। বাংলার ছাত্রজনতা রাষ্ট্রভাষার দাবিতে হাতে নেয় ঐক্যবদ্ধ কর্মসূচি। সেই কর্মসূচির অংশ হিসেবে ১৯৫২ সালে ৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকা শহরের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পালিত হয় ছাত্র ধর্মঘট।
বায়ান্নোর একুশে ফেব্রুয়ারির দিনটি ছিল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান আইন পরিষদের অধিবেশন বসার দিন। আর সেই একুশে ফেব্রুয়ারিতেই সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে পূর্ব পাকিস্তানে হরতাল ও বিক্ষোভ মিছিল পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এ সিদ্ধান্তে সব পর্যায়ের ছাত্রজনতা ছিল ঐক্যবদ্ধ; যেন জীবনপণ সংগ্রামে লিপ্ত। সেদিনের সেই তারুণ্য দেশের ভবিষ্যৎ আলোকবর্তিকা হয়ে প্রতিভাত হয়েছিল। আর সেই হরতাল বানচাল করার উদ্দেশ্যে পাকিস্তান সরকার ২০ ফেব্রুয়ারি থেকে জারি করে ১৪৪ ধারা।
নয়াশতাব্দী/জেডআই
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ