নয়া শতাব্দী অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি।
গত ১৩ ফেব্রুয়ারি দেশের ২২তম রাষ্ট্রপতি হিসেবে দুর্নীতি দমন কমিশনের সাবেক কমিশনার মো. সাহাবুদ্দিনকে নির্বাচিত করে প্রজ্ঞাপন জারি করে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এর পরই দুদক আইনের একটি ধারা উল্লেখ করে সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক ‘রাষ্ট্রপতি পদ’ লাভজনক কিনা— এমন প্রশ্ন তুলে একটি বহুল প্রচারিত দৈনিকে নিবন্ধ লেখেন। তবে ড. শাহদীন মালিকের দাবিকে সরাসরি নাকচ করে দিয়েছে নির্বাচন কমিশন। গতকাল মঙ্গলবার নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর পুরো বিষয়টি ব্যাখ্যা করে বলেন, আইন-কানুন জেনেই রাষ্ট্রপতি পদে মো. সাহাবুদ্দিনকে নির্বাচিত করে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলমসহ আরও বিশিষ্টজনেরা শাহদীন মালিকের দাবি নাকচ করে দিয়েছেন।
জানা যায়, দেশের নতুন নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন এক সময় দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কমিশনার ছিলেন। দুদক আইনে বলা আছে, দুদকের কোনো কমিশনার অবসর নেয়ার পর প্রজাতন্ত্রের কোনো লাভজনক পদে নিয়োগের যোগ্য হবেন না। মো. সাহাবুদ্দিন রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ার পর দুদক আইনের সূত্র ধরে রাষ্ট্রপতি পদ লাভজনক কি না, এ প্রশ্ন তোলা হয়েছে।
সংবিধানের ৬৬ অনুচ্ছেদে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার যোগ্যতা ও অযোগ্যতা সম্পর্কে বলা রয়েছে। এ অনুচ্ছেদ অনুসারে, ‘কোনো ব্যক্তি কেবল রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার, ডেপুটি স্পিকার, মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, উপমন্ত্রী হইবার কারণে প্রজাতন্ত্রের কর্মে কোনো লাভজনক পদে অধিষ্ঠিত বলিয়া গণ্য হইবেন না।’
এ ধারার ব্যাখ্যায় শাহদীন মালিকের দাবি, রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রীসহ অন্য যে পদগুলোকে লাভজনক নয় বলা হয়েছে, তা শুধু সংসদ নির্বাচনের জন্য প্রযোজ্য। তিনি বলেন, রাষ্ট্রপতি পদে মেয়াদ শেষ হওয়ার পর অতীতে অনেকে সংসদ নির্বাচন করেছেন। এ কারণে সংসদ নির্বাচিত হওয়ার যোগ্যতার শর্তের ক্ষেত্রে সংবিধানে এ বিধান আনা হয়েছে।
এ বিষয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, রাষ্ট্রপতির পদ অলাভজনক হওয়ার পরও অহেতুক বিতর্ক সৃষ্টি করা হচ্ছে। তিনি বলেন, এ বিষয়ে উচ্চ আদালতের একটি রায়ও রয়েছে। এর বাইরে সংবিধানের ১৪৭ অনুচ্ছেদেও বিষয়টি স্পষ্টভাবে বলা আছে যে— রাষ্ট্রপতি পদ লাভজনক নয়।
নির্বাচন কমিশনের পক্ষে নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীরও স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি পদটি লাভজনক নয়। ফলে দুদকের সাবেক কমিশনার মো. সাহাবুদ্দিনের রাষ্ট্রপতি পদে আসীন হতে কোনো বাধা নেই। গতকাল মঙ্গলবার নির্বাচন ভবনের নিজ দফতরে সাংবাদিকদের এমন দাবি করেন তিনি।
ইসি আলমগীর বলেন, দুদকের আইনে বলা আছে যে, কমিশনাররা লাভজনক পদে যেতে পারবেন না। কিন্তু আপনারা জানবেন যে, নির্বাচন কমিশন যখন এটি করেছে, তখন আইন-কানুন জেনেই এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বিচারপতি সাহাবুদ্দীন যখন রাষ্ট্রপতি পদে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন, তখন এ নিয়ে কোর্টে একটি মামলা হয়েছিল। কারণ বিচারপতির ক্ষেত্রেও একই আইন যে, তারা লাভজনক পদে যেতে পারবেন না।
তিনি বলেন, ওই মামলায় হাইকোর্ট একটি রায় দিয়েছিলেন। সেখানে হাইকোর্ট বলে দিয়েছেন যে, না— এতে কোনো বাধা নেই এবং সেই আদেশের বিরুদ্ধে কোনো আপিলও হয়নি। যেহেতু আমাদের সামনে উচ্চ আদালতের একটি সুনির্দিষ্ট উদাহরণ রয়েছে, মহামান্য রাষ্ট্রপতির পদকে লাভজনক পদ বলা যাবে না এবং ওই রায়ে বলা আছে, লাভজনক পদ বলতে বোঝাবে প্রজাতন্ত্রের যারা কর্মকর্তা-কর্মচারী তাদের। অতএব, এটি তার (মো. সাহাবুদ্দিন) জন্য প্রযোজ্য নয়। তার রাষ্ট্রপতি পদে আসীন হতে আইনগত কোনো বাধা নেই।
আরেক প্রশ্নের জবাবে নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর বলেন, লাভজনক পদের বিষয়ে একেবারে স্পষ্টভাবে বলা আছে যে, লাভজনক পদ বলতে কী বোঝায়— যদিও তালিকা দেয়া নেই, তবে লাভজনক পদের ক্ষেত্রে বলা আছে যে, প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োজিত এবং কোনো প্রতিষ্ঠানে যদি সরকারের ৫০ ভাগের অধিক অর্থ থাকে, তাহলে সেই পদে নিয়োগকে বলা হবে লাভজনক পদ। তো এখানে রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রী বা মন্ত্রী, তারা কিন্তু প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োজিত কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী নন। এগুলো সাংবিধানিক পদ।
ইসি আলমগীর বলেন, যেহেতু সাংবিধানিক পদ, সেহেতু লাভজনক পদের ডেফিনেশনে (সংজ্ঞা) তারা পড়েন না— আবার যেহেতু এটি নিয়ে একটি মামলা হয়েছিল এবং আমাদের আইন যা বলে তা হলো, হাইকোর্ট বা আপিল বিভাগের যদি কোনো রায় থাকে, সেই রায় আইন হিসেবে গ্রহণ করা হবে। যেহেতু বিচারপতি সাহাবুদ্দীন রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নেয়ার সময় মামলা হয়, তখন এ মামলাটি খারিজ হয়ে গিয়েছিল, আদালত স্পষ্টভাবে জানিয়েছেন মহামান্য রাষ্ট্রপতির পদটি লাভজনক পদ নয়। এটি সাংবিধানিক পদ। অতএব, এটি নতুন রাষ্ট্রপতির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না।
রাষ্ট্রপতি পদে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ দিন ছিল ১৪ ফেব্রুয়ারি। তার আগেই বাছাইয়ের দিন (১৩ ফেব্রুয়ারি) রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত ঘোষণা করে গেজেট করা হলো— এভাবে আইন অনুযায়ী তার মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের সুযোগ বন্ধ করে দেয়া হলো কি না বা বিষয়টি আইনসিদ্ধ হলো কি না— এমন প্রশ্নে ইসি আলমগীর বলেন, এটি অবশ্যই আইনসিদ্ধ। আইনে স্পষ্ট লেখা আছে যে, যদি একাধিক প্রার্থী না থাকে এবং মনোনয়নপত্র বাছাই করার পর যদি দেখা যায় যে, মনোনয়নপত্র সঠিক ও বৈধ, তাহলে ওই সময় তাকে নির্বাচিত হিসেবে ঘোষণা দেয়া হবে। এক্ষেত্রে আর প্রত্যাহার করার জন্য অপেক্ষা করার প্রয়োজন নেই।
শাহদীন মালিকের ব্যাখ্যার সঙ্গে একমত নন আরেক সংবিধান বিশেষজ্ঞ প্রবীর নিয়োগী। এ সংবিধান বিশেষজ্ঞ বলেন, সংবিধানে ৬৬ অনুচ্ছেদ অনুসারে রাষ্ট্রপতির পদ লাভজনক নয় বলেই বিবেচনা করতে হবে। একই মত দুর্নীতি দমন কমিশনের আইনজীবী খোরশেদ আলমেরও। তিনি বলেন, সংবিধানের এ বিধানই স্পষ্ট করে দিয়েছে যে, রাষ্ট্রপতির পদ লাভজনক নয়। ফলে দুদক আইন অনুযায়ী, দুদক কমিশনারের পদ থেকে অবসর নেয়ার পর প্রজতন্ত্রের কোনো লাভজনক পদে অধিষ্ঠিত হওয়া যাবে না বলে যা বলা হচ্ছে, সেটি সংবিধান অনুসারে রাষ্ট্রপতি পদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না। তিনি আরও বলেন, ২০১১ সালে সংবিধানে যে পঞ্চদশ সংশোধনী আনা হয়, তাতেও রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর পদকে অলাভজনক বলে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রসঙ্গত, রাষ্ট্রপতির পদ লাভজনক কি না, তা নিয়ে ১৯৯৬ সালে হাইকোর্টে একটি রিট মামলা হয়েছিল। তখন শেখ হাসিনার নেতৃত্বে প্রথম দফায় আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে সাবেক প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করা হয়েছিল। তখন হাইকোর্টে রিট মামলায় অভিযোগ করা হয়, প্রধান বিচারপতি থেকে অবসর নিয়ে রাষ্ট্রের কোনো লাভজনক পদে অধিষ্ঠিত হওয়া যায় না। ফলে সাহাবুদ্দীন আহমদ রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচন করতে পারেন না। রিট মামলার সেই অভিযোগের শুনানি শেষে হাইকোর্ট রাষ্ট্রপতির পদ লাভজনক নয় বলে রায় দিয়েছিলেন। হাইকোর্টে যে দুজন বিচারপতি সেই রায় দিয়েছিলেন, তাদের একজন বিচারপতি আব্দুল মতিন এখন অবসর জীবনে রয়েছেন। তিনি বলেন, মামলার শুনানি যুক্তি ও প্রেক্ষাপট বিবেচনা করেই ওই সময় অমন রায় দেয়া হয়েছিল।
নয়াশতাব্দী/জেডআই
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ