নয়া শতাব্দী অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি।
জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে সৃষ্টি করা সনদপত্র দিয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) একজন কর্মকর্তা দীর্ঘদিন চাকরিতে রয়েছেন বহাল তবিয়তে। পেয়েছেন পদোন্নতিও। ছিলেন প্রশাসন দফতরেরও গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে। বিষয়টি ডিএসসিসিতে ওপেন সিক্রেট হলেও ভয়ে মুখ খুলছেন না অনেকেই।
জানা যায়, ডিএসসিসির অঞ্চল-৩ এর সমাজকল্যাণ শাখার কেয়ারটেকার থাকাকালে মেহেদী হাসান খান উচ্চশিক্ষার জন্য অর্থাৎ ব্যাচেলর অব আর্টস (বি.এ) পড়ার অনুমতি চেয়ে সংস্থার সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে ১৯৯২ সালের ২৫ জানুয়ারি আবেদন করেন। শর্তসাপেক্ষে ডিএসসিসি কর্তৃপক্ষ তাকে ওই বছরেই ১৫ এপ্রিল উচ্চশিক্ষার অনুমতি দেন। বিশেষ করে অফিসের কাজে ব্যাঘাত সৃষ্টি না করে নৈশকালীন সময়ে তাকে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের অনুমতি প্রদান করা হয়। তবে অবিশ্বাস্য বিষয় হলো- মেহেদী হাসান খান পরে ব্যাচেলর অব আর্টস (বি.এ) পাসের যে সনদপত্র সংস্থায় দাখিল করেছেন সেটি ওই একই বছর- ১৯৯২ সালের। অর্থাৎ অনুমতি চেয়ে আবেদন, সংস্থার অনুমতি প্রদান এবং সার্টিফিকেটে পাসের শিক্ষাবর্ষ একই বছর। যার ফলে স্বাভাবিকভাবেই বিভিন্ন প্রশ্নের উদ্ভব ঘটেছে— একই বছরে কিভাবে উচ্চশিক্ষার আবেদন, সংস্থার অনুমতি আবার সেই বছরেই সনদপত্র হয়! তাহলে শিক্ষাবর্ষ কবে হলো। এরই মধ্যে এ সার্টিফিকেটের মাধ্যমে পদোন্নতি পেয়ে হয়েছেন ডিএসসিসি’র উপ-কর কর্মকর্তা (ডিটিও)। ডিএসসিসিতে মেহেদী হাসান খানের দাখিলকৃত বি.এ পাসের সনদপত্রের সিরিয়াল নম্বর ৩৯১৯। যা বাংলাদেশ ব্যাংক প্রধান কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক শহীদুর রহমান খান নামীয় ১৯৯৫ সালের ২২ জানুয়ারি তারিখে সত্যায়ন করা। যদিও সত্যায়নকরণও সঠিক ব্যক্তির স্বাক্ষর নয় বলে অভিযোগ রয়েছে। অর্থাৎ সনদপত্রটি সত্যায়ন করতেও মেহেদী হাসান খান জালিয়াতির আশ্রয় নিয়েছেন বলে দাবি তাদের।
গুঞ্জন আছে, মেহেদী হাসান খান ইতোমধ্যেই একটি চক্রকে মোটা অঙ্কের টাকা উৎকোচ দিয়ে সংস্থার গুরুত্বপূর্ণ পদ সহ-সচিব হিসেবেও দায়িত্ব নিয়েছিলেন। কিন্তু অদক্ষতাসহ নানাবিধ কারণে তিনি সেখানে বেশিদিন টিকতে পারেননি বলে গুঞ্জন রয়েছে। তবে পরে তিনি পেয়েছেন পদোন্নতি। যা নিয়েও রয়েছে বিভিন্ন আলোচনা-সমালোচনা। তবে এ ব্যাপারে কেউই প্রকাশ্যে মুখ খুলতে সাহস পাচ্ছেন না। কারণ তিনি সংস্থার প্রভাবশালী একজনের সঙ্গে লেনদেনের মাধ্যমেই এসব করেছেন। ফলে এ ব্যাপারে কেউ মুখ খুললেই তাকেই বিপদগ্রস্ত হবার আশঙ্কা রয়েছে বলে জানা গেছে।
তবে জোর গুঞ্জন রয়েছে, ভাণ্ডার বিভাগের সদ্য সাবেক একজন কর্মচারীর মাধ্যমে ৭ লাখ টাকার বিনিময়ে মেহেদী হাসান খান ডিএসসিসি’র সহ-সচিব-১ পদে দায়িত্ব নেন। ভাণ্ডার বিভাগের ওই কর্মচারী স্ব-ঘোষিত শ্রমিক লীগের নেতা বলে দাবি করতেন। অথচ সম্প্রতি শ্রম অধিদফতর থেকে বলা হয়েছে তিনি শ্রমিক লীগের কেউ নন, এমনকি একজন সাধারণ সদস্যও নন। তবে সংস্থার একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার যোগসাজশে তিনি সংস্থার অনেক কর্মকর্তাকেও নানাভাবে হয়রানি ও হেনস্তা করেছেন বলেও সূত্রে জানা যায়।
এছাড়া মেহেদী হাসান খান অঞ্চল-২ এর সমাজকল্যাণ বিভাগের কর্মচারী থাকাকালে গুলিস্তান গোলাপ শাহ মাজারের টাকা এবং বিভিন্ন কমিউনিটি সেন্টারের টাকা কোষাগারে জমা না দিয়ে নিজে আত্মসাৎ করেছেন মর্মেও অভিযোগ রয়েছে। আর অনৈতিকভাবে উপার্জিত অর্থ দিয়ে তিনি সাভার এলাকায় বহুতল বিশিষ্ট একটি বিলাশবহুল বাড়িও নির্মাণ করেছেন বলে অভিযোগে প্রকাশ।
এ ব্যাপারে মেহেদী হাসান খান বলেন, আমার কোনো শিক্ষা সনদ জাল নয়। উচ্চশিক্ষার আবেদনের তিন মাসের মধ্যে সংস্থা থেকে শর্ত সাপেক্ষে অনুমতি দেয়ার বছরই কিভাবে আপনি বিএ পাস করলেন (সংস্থায় দাখিলকৃত সনদপত্র অনুযায়ী) এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, আমি কবে আবেদন করেছি আর কতদিন পর অনুমতি দিয়েছে তা আমার খেয়াল নেই। অপর এক প্রশ্নে তিনি বলেন, ডিএসসিসিতে দাখিলকৃত আমার বিএ শিক্ষা সনদের সত্যায়ন প্রকৃত কর্মকর্তাই করেছেন, কোনো ধরনের জালিয়াতির আশ্রয় গ্রহণ করা হয়নি।
ডিএসসিসি’র সচিব আকরামুজ্জামানের মোবাইল ফোনে এ ব্যাপারে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তা সম্ভব হয়নি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ডিএসসিসি’র একজন সহ-সচিব বলেন, সংস্থা থেকে উচ্চশিক্ষার জন্য অনুমতি দেয়ার বছরই শিক্ষাবর্ষ দেখিয়ে প্রকৃত শিক্ষা সনদ পাওয়া অসম্ভব। কারণ অনুমতি পাওয়ার পর ভর্তি হতে হবে। এরপর ক্লাস ও পরীক্ষায় পাস করতে হবে। এতে অন্তত দেড় থেকে দুই বছর লাগার কথা। এর ব্যত্যয় ঘটলে স্বাভাবিকভাবেই অনুমেয় ‘ডাল মে কুছ কালা হায়।’
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সমাজের চোখে যা কিছু নৈতিকতার ব্যত্যয় ঘটলে তাকে স্খলন বা চ্যুতি ঘটেছে বলে ধরে নেওয়া হয়। ন্যায়বিচার, সততা, নৈতিক সদগুণের যা কিছু বিপরীত, তা-ই নৈতিক স্খলন। যার যার ক্ষেত্র বিবেচনা করে সেটিকে ব্যাখ্যা করা হয়। বিশ্লেষকরা দুটি সুনির্দিষ্ট প্রশ্ন দিয়ে এর ফয়সালার কথা বলছেন। ১. যা ঘটেছে তা সাধারণভাবে বিবেক বা সমাজকে আঘাত দিয়েছে কিনা এবং ২. ঘটনাটি অপরাধের উদ্দেশে ঘটানো হয়েছিল কিনা? এ দুটি প্রশ্নের উত্তরের ভিত্তিতে প্রাথমিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর আইনে কী আছে এবং কোনটি তার জন্য প্রযোজ্য সেদিকে এগোনো যেতে পারে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক ও অপরাধ গবেষক তৌহিদুল হক বলেন, অপরাধীরা শাস্তির ভয় না পেলে অপরাধ দমন কঠিন। যে কোনো দেশে অপরাধের সঠিক বিচার ব্যবস্থা ও আইনের প্রয়োগ থাকলে সামাজিক অপরাধ অনেক কম হয়। এর ব্যত্যয় ঘটলে ছোটখাটো সামাজিক অপরাধের সঙ্গে জড়িতরা এক সময় বড় অপরাধের সঙ্গে যুক্ত হন। আবার একটি অপরাধ আড়ালে আরও একাধিক অপরাধ সংঘটিত করে, আশ্রয় নেয় মিথ্যাচারের। এছাড়া রাজনৈতিক হস্তক্ষেপে অপরাধীরা পার পেয়ে যাওয়ায় নানা ভয়ঙ্কর অপরাধ বেড়েছে। এ অপরাধ গবেষক বলেন, ৫০ বছর আগেও অনেক ধরনের অপরাধ ছিল; যেসব অপরাধের বিচার সামাজিক অনুশাসনের মাধ্যমে হতো। এখন তারচেয়ে আধুনিক ও সময়োপযোগী ব্যবস্থা নেওয়া হলেও অপরাধ কমছে না। সুশাসনের জন্য নাগরিকের বদিউল আলম মজুমদার মনে করেন নৈতিক স্খলনকে সমাজের দৃষ্টিকোণ দিয়েই বিচার করতে হয়। তিনি বলেন, ‘আমরা যদি পেশাগত জায়গা নিয়ে কথা বলি তাহলে বলতে হয়, সরকারি কর্মচারীরা কী করবেন, করবেন না তা নির্ধারিত আছে।’ এর বাইরে তাদের যাওয়ার সুযোগ নেই বলে মন্তব্য করেন তিনি।
নয়াশতাব্দী/জেডআই
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ