নয়া শতাব্দী অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি।
বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকের ঘটনা। কলকাতার সুদর্শন পুলিশ কর্মকর্তা ধীরাজ ভট্টাচার্য্য বদলি হয়ে আসেন দুর্গম জনপদ, পাহাড় ও নদী ঘেরা টেকনাফ থানায়। তার আবাস হয় থানার আধাপাকা ঘরের একটি কক্ষেই। চলাচলে নদী ও সাগর পথ-ই অন্যতম ভরসা, প্রায় জনশূন্য টেকনাফে তেমন কোনো কাজ ছিল না। তাই দিনের বেলা এলাকার এখানে-সেখানে ঘুরেই সময় কাটালেও ল সন্ধ্যা হলেই একাকিত্বে আনমনা হতেন ধীরাজ।
সেসময় সমগ্র টেকনাফে সূপেয় পানীর একটি মাত্র উপলক্ষ্য ছিল থানা কম্পাউন্ডের পাতকুয়া (কুপ)। একদিন ভোরে একাধিক নারীকণ্ঠের অস্পষ্ট মৃদু গুঞ্জনে ধীরাজের ঘুম ভাঙ্গে। থানার ছোট বারান্দায় এসে দেখেন রঙ-বেরঙের ফতুয়া (থামি-ব্লাউজ) পরিহিত জনাবিশেক রাখাইন তরুণী পাত কুয়ার (কুয়া) চারদিকে জড়ো হয়ে হাসি গল্পে মশগুল। তাদের সুউচ্চ কলহাস্যে থানা প্রাঙ্গণ মুখরিত।
প্রতিদিন তরুণীরা পাত কুয়ায় জল নিতে আসতেন। আর ধীরাজ থানার বারান্দায় চেয়ারে বসে দেখতেন তরুণীদের জল তোলার দৃশ্য। একদিন ধীরাজের নজরে পড়ে সম্পূর্ণ নতুন সাজে সজ্জিত এক তরুণীকে। সুন্দরী এই তরুণীর নাক-চোখ পুরো অবয়ব বাঙালি মেয়েদের মতোই। খবর নিয়ে জানলেন মেয়েটি টেকনাফের জমিদার ওয়ানথিনের একমাত্র মেয়ে, মাথিন। প্রথম দর্শনেই মেয়েটিকে ভালো লেগে যায় ধীরাজের। এরপর থেকে প্রতিদিন ভোর হওয়ার আগেই পুলিশ ধীরাজ থানার বারান্দায় চেয়ারে বসে প্রেমিক ধীরাজ হয়ে মাথিনের আসা অপেক্ষা করতেন।
মাথিনের কলসি কাঁখে সুউচ্চ গ্রীবা দুলিয়ে কূপে আসা-যাওয়ার দৃশ্য তন্ময় হয়ে উপভোগ করতেন ধীরাজ। অন্য তরুণীদের আগেই মাথিন পাত কুয়ায় এসে জল নিয়ে ফিরতেন। মাথিনও বুঝতে পারছিল সুদর্শন এক পুলিশ কর্মকর্তা তার অপেক্ষায় থাকেন! এভাবে পানির বাহানায় মাথিনও নিয়মিত কূপে আসতেন। ভোরের স্নিগ্ধ আলোয় নীরব নিস্তব্ধ পরিবেশে একে অপরকে শব্দহীন চোখে দেখতেন। এভাবেই একের প্রতি অন্যের টান গভীর প্রেমে আচ্ছন্ন হয়ে উঠে। দিন গড়াতে থাকে- একান হতে ওকান হয়ে দু’জনের প্রেমের কথা চারপাশে চাউর হয়। ঘটে নানা বিপত্তি। দুইজনই সিন্ধান্ত নেয় বিয়ের। প্রথমে বাদ সাদলেও মেয়ের আগ্রহে রাজী হন মাথিনের বাবা ওয়ানথিনও।
কিন্তু ইতোমধ্যে এই অসম প্রেমের কথা ধীরাজের ব্রাহ্মণ পিতা জেনে যান। জরুরি টেলিগ্রাফ মারফত অসুস্থতার কথা বলে ধীরাজকে দ্রুত কলকাতা ফিরে যেতে বলে তার পিতা। ছুটি না মিললে চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে হলেও যেতে হবে। সিদ্ধান্তের কথা মাথিনকে জানানো হয়। তবে মাথিন রাজি হলেন না। তাই অনেকটা বাধ্য হয়েই ধীরাজ এক সন্ধ্যায় টেকনাফ ছেড়ে একপ্রকার পালিয়ে গেলেন।
ধীরাজের এভাবে চলে যাওয়াকে প্রেমিকা মাথিন সহজে মেনে নিতে পারেননি। মাথিনের মনে হল, বাবার অসুখের কারণ দেখিয়ে ধীরাজ তাকে বিয়ের ভয়ে পালিয়েছে। প্রাণ পুরুষ ধীরাজকে হারিয়ে মাথিন অন্ন-জল ত্যাগ করে হন শয্যাশায়ী। জমিদার বাবা ওয়ানথিনসহ পরিবারের সদস্যরা শত চেষ্টা করেও মাথিনকে অন্নজল ছোঁয়াতে পারেননি। তার এক কথা-ধীরাজকে চাই। ধীরাজের প্রহর গুনতে গুনতে খাওয়া-দাওয়া ছেড়ে কঙ্কালসার হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন মাথিন।
প্রেমের এই বিচ্ছেদ এবং অতি কষ্টে একদিন মাথিন মারা যান। এ কারণে পুলিশ কর্মকর্তা ধীরাজ ভট্টাচার্য্য ও রাখাইন তরুণী মাথিনের ভালোবাসা আর ট্র্যাজেডির ঐতিহাসিক প্রেমের সাক্ষী ‘মাথিনের কূপ’ দেখে এখনো অগণিত প্রেমিক-প্রেমিকা তাদের অমর প্রেমের কথা স্মরণ করে আবেগাপ্লুত হয়।
১৯৩৫ সালে ধীরাজ ভট্টাচার্যের ব্যক্তিগত জীবনী নিয়ে লেখা ‘যখন পুলিশ ছিলাম‘ গ্রন্থে তার অতৃপ্ত ভালোবাসার স্মৃতি প্রকাশ পায়। এ নিয়ে সংবাদ প্রকাশের পর ১৯৮৪ সালের ১৪ এপ্রিল থানা কম্পাউন্ডের সেই পাতকুয়াটি 'মাথিনের কূপ' নামে একটি সাইনবোর্ড টাঙিয়ে সংস্কার করা হয়। এরপর হতে ভালবাসার নিদর্শন হিসেবে এটি হয়ে ওঠে পর্যটকদের জন্য এক দর্শনীয় স্থান। তবে, পর্যটক ও দর্শণার্থীদের অভিমত কূপের পাশে পুলিশ কর্মকর্তা ধীরাজের ভাষ্ককর্যের পাশাপাশি মাথিনেরও অবয়ব দেয়া দরকার। বিয়োগান্ত ভালবাসার নির্দশনে এ অবয়ব অন্যরকম ভালো লাগা তৈরি করতো।
দেশের সর্বদক্ষিণ স্থলসীমান্ত শহর কক্সবাজারের টেকনাফ। মিয়ানমার-বাংলাদেশকে বিভক্ত করা নাফনদীর তীর ঘেঁষে গড়ে উঠা টেকনাফ শহরের লামার বাজার এলাকায় থানা কম্পাউন্ড। স্বভাবতই থানায় লোকজন আসেন নিজেদের উপর চলা ফৌজদারি অন্যায়ের বিচার কিংবা আইনশৃংখলা অবনতি জনিত সমস্যা সমাধানের আশায়। কিন্তু টেকনাফ থানা কম্পাউন্ডে বিচারপ্রার্থী ছাড়াও প্রেম পূজারি আবেগপ্রবণ নারী-পুরুষের আগমণ ঘটে প্রতিনিয়ত। পুলিশ কর্মকর্তা ও রাখাইন জমিদার কন্যা মাথিনের অসমাপ্ত বিয়োগান্তক প্রেমের স্বাক্ষী, অমর নিদর্শন ‘মাথিনের কূপ’ দেখেন তারা। শতবছরের পুরোনো এক বিয়োগান্ত প্রেমের কাহিনি থানা কম্পাউন্ডে সংরক্ষিত কূপ ঘেরা দেয়ালে শোভা পাচ্ছে। বিমোহিত হয়ে সেই গল্প পড়ছেন পর্যটক ও স্থানীয় দর্শণার্থী।
ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা থেকে সদ্য বিয়ে করা বউকে নিয়ে কক্সবাজার ঘুরতে এসে মাথিনের কূপ দেখতে আসা মনিরুজ্জামান বলেন, ‘যখন পুলিশ ছিলাম’ বইটি ছাত্রজীবনে পড়েছি। তখন থেকেই ইচ্ছে ছিল মাথিন আর ধীরাজের ভালবাসার নিদর্শন কূপটি দেখবো। জীবনসঙ্গীসহ দেখার সৌভাগ্য হলো। ভালবাসার জন্য মাথিনের ত্যাগ সত্যি বিয়োগান্তের পাশাপাশি গর্বেরও।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সায়মা সুলতানা বলেন, মাথিন-ধীরাজের ভালবাসার বিষাদময় পরিসমাপ্তি চরম কষ্টের। লাইলি-মজনু, শিরি-ফরহাদসহ যুগে যুগে ভালবাসার জন্য জীবন দেয়া আরেকটি অমর গাঁথা ধীরাজ-মাথিন। এখানে ধীরাজের সাথে মাথিনের অবয়ব হলে কূপের দৃশ্যটি আরো সুনিপুণ হতো। আজ ১৪ ফেব্রুয়ারি, বিশ্ব ভালোবাসা দিবস। বাংলা অব্দে আজ পহেলা ফাল্গুনও। প্রতিবছর এদিনে, মাথিনের কূপে ভিড় জমান দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছুটে আসা প্রেম পিয়াসীরা। কূপের সামনে দেয়ালে লেখা, তাদের অমর প্রেমের গল্প পড়ে মুগ্ধ হন এসব দর্শনার্থী। আবার অনেকেই বিয়োগান্তক এ ভালোবাসার গল্প পড়ে আবেগ তাড়িত হয়ে পড়েন।
মাথিন ট্র্যাজেডির দায় কার? পুলিশ কর্মকর্তা ধীরাজ ভট্টাচার্যের ফিরে না আসা-নাকি সেদিনের সমাজ ব্যবস্থা? এ নিয়ে নানা প্রশ্ন থাকলেও, ভালবাসার এই নির্দশন ভালো বাসাবাসি মানুষের জন্য কালের সাক্ষী মিলনস্থলে পরিণত হয়েছে।
কক্সবাজার জেলা পুলিশের মুখপাত্র অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, বৃটিশ শাসনামলে আমাদেরই এক পূর্বসূরীর অতৃপ্ত ভালবাসার নিদর্শনটি অতিযত্নে সংস্কার করা হয়েছে। সকলের সহযোগিতায় দেশবাসীর কাছে মাথিনের কূপ হয়ে উঠবে এক আকর্ষণীয় স্থান, এমনটি মনে করেন তিনি।
উল্লেখ্য, কলকাতার সেই সময়ের সুদর্শন যুবক পুলিশ কর্মকর্তা ধীরাজ ও রাখাইন তরুণী মাথিনের ভালোবাসা ও ট্র্যাজেডির অমর প্রেমগাঁথা স্মৃতি নিয়ে ১৯৩৫ সালে পাকিস্তানের লাহোরের ইউনিক পাবলিকেশন থেকে ‘যখন পুলিশ ছিলাম’ নামে একটি গ্রন্থ প্রকাশ করা হয়। যা ধীরাজ ভট্টাচার্য্যের আত্মজীবনী মূলক লেখা।
নয়াশতাব্দী/জেডএম
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ