নয়া শতাব্দী অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি।
হলে গিয়ে বড়পর্দায় সিনেমা দেখা একসময় বাঙালির কাছে ছিল বিনোদনের আকর্ষণীয় মাধ্যম। বিশেষ দিন কিংবা নতুন সিনেমা মুক্তির দিনগুলোতে হলে রীতিমত দর্শকে ভরপুর হতো। মানুষ সিনেমা দেখতে হলে টিকিট কেনার জন্য ও হলে প্রবেশের জন্য লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষায় থাকতো। প্রচণ্ড গরম কিংবা বৃষ্টি বাধা হতে পারতো না।
বিশেষ করে ঈদের দিনে সিনেমা দেখতে ঢল নামতো প্রতিটি সিনেমা হলে। সিনেমার টিকিট শেষ হয়ে যেতো। দর্শকের চাহিদা পূরণ করতে অনেকে কালোবাজারিতে টিকিট বিক্রি করে ব্যবসা করতো। সিনেমার মতো কথা বলা, পোশাক পরা, সংস্কৃতির একটা
কালের বিবর্তনে আধুনিক যুগের দর্শকরা বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে চলচ্চিত্রকে বাদ দিয়ে অন্য কিছু বেছে নিয়েছে। বর্তমান
জগতের বিস্ময় মোবাইল ফোন বিশ্বকে হাতের মুঠোয় নিয়ে এসেছে। এখন আর সিনেমা হল কিংবা টেলিভিশন লাগে না।
ফলে দর্শক সংকট থাকায় সিনেমা হলে প্রভাব পড়েছে।ব্রিটিশ আমলে টাঙ্গাইলের প্রাণকেন্দ্রে একটি সিনেমা হল ছিলো। পরবর্তীতে টাঙ্গাইল শহরে ৫টি সিনেমা হলে রমরমা ব্যবসা হয়েছে। শহরের প্রাণকেন্দ্রে থাকায় প্রতিটি হলে দর্শক সমাগম ছিল দেখার মতো। বর্তমানে টাঙ্গাইল শহরের সিনেমা হলগুলো হারিয়ে গেছে। শহরের সিনেমাপ্রেমী দর্শকের বিনোদনের শেষ সিনেমা হল মালঞ্চ হলটিও ভেঙে ফেলা হচ্ছে। সেখানে ১০ তলা মালঞ্চ টাওয়ার নির্মাণ করা হবে। এর মধ্য দিয়ে শহরের সব সিনেমা হলই হারিয়ে গেলো। গতবছরের ১৮ ডিসেম্বর বড় পর্দার বিনোদনের মাধ্যম মালঞ্চ সিনেমা হল ভাঙার কাজ শুরু হয়েছে।সিনেমা হলটি যখন ভাঙা হয় তখন এতে আন্ডারওয়ার্ল্ড সিনেমাটি প্রদর্শিত হয়েছে।
জানা যায়, ১৯৭৫ সালে ৩০ শতাংশ জমির উপর বাসাইল উপজেলার ময়থা গ্রামের সাধুলীপাড়ার বাসিন্দা আতাউর রহমান মানিক তার ৩ ভাই বজলুর রহমান হীরা, লুৎফর রহমান ছানা ও ফয়জুর রহমান মাখনকে নিয়ে নির্মাণ করেন ‘মালঞ্চ সিনেমা হল’। নায়ক ওয়াসীম ও ভিলেন জসীমের জিঘাংসা সিনেমা দিয়ে বড়পর্দাটি চালু হয়। যদিও মালঞ্চ সিনেমাটি ১৯৭২ সালে শহরের প্যারাডাইসপাড়ায় গুদাম ঘর ভাড়া নিয়ে চালু করা হয়। শুরুতে তারা ৪ ভাই টাঙ্গাইল শহরে বাসা ভাড়া করে থাকতেন আর ভিক্টোরিয়া রোডে (বর্তমান কিছুক্ষণ হোটেল) সুরুচি হোটেল চালাতেন।
স্বাধীনতার পর সুরুচির নিকটবর্তী রওশন সিনেমা হলের মালিক মোজাহারুল ইসলাম চৌধুরী লেবু যখন তার অধীনে থাকা মির্জাপুর ও অনামিকা সিনেমা হল ছেড়ে দিতে চাইলেন তখন তারা দুই ভাই মির্জাপুর হলটির দায়িত্ব নিয়ে নিলেন এবং নতুন করে নাম দিলেন মুক্তা সিনেমা হল। বছর দুই ব্যবসা করার পর মালঞ্চ সিনেমা হল চালু করেন।
২০০০ সালের দিকে সিনেমা ব্যবসায় ভাটা আসতে থাকে। ভালো মানের সিনেমা তৈরি না করে নোংরা সিনেমা তৈরিতে যখন বাজার সয়লাব তখন রুচিবান দর্শকরা সিনেমা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। সিনেমা পাইরেসি ছাড়াও বিনোদনের মাধ্যম মোবাইল ধীরে ধীরে মানুষের আস্থা অর্জন করতে থাকে। তখন মালঞ্চ সিনেমা হলটি প্রবাসী নাফিজ আহমেদ জুয়েল নামে এক ব্যক্তির নিকট বিক্রি করে দেন আতাউর রহমান মানিক ও তার ভাইয়েরা।
মালঞ্চ হলে চাকরি করতেন জাহিদ মন্ডল। তিনি প্রবাসী মালিক জুয়েল কাছ থেকে ভাড়া নিয়ে সিনেমা হল চালাতে থাকেন। প্রায় বছর দশেক হল সিনেমা ব্যবসায় লোকসান গুনেও সরকারের সহযোগিতার আশায় ব্যবসা চালিয়েছেন। তখন টাঙ্গাইল শহরে একটি সিনেমা হল ছিল।
জেলার সাংস্কৃতিক কর্মীরা বলেন, প্রথমে ব্রিটিশ আমলে মানদানি নামের একটি সিনেমা হল ছিলো। পরবর্তীতে তা বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৬০ সালের দিকে শহরের পার্ক বাজারের পাশে আরফান খানের গুদাম ঘর ভাড়া নিয়ে কালী সিনেমা চালু হয়। পরে যেটি রওশন টকিজ নাম দিয়ে শহরের নিরালা মোড়ে করোনেশন ড্রামাট্রিক ক্লাব (সিডিসি) হল রুম ভাড়া নিয়ে সিনেমা হল চালানো হয়। স্বাধীনতার পর পর সিনেমা হলটি বিক্রি করে দেয়া হয়।
১৯৭৬ সালের শুরুর দিকে রওশন টকিজের অংশীদারগণ ও ৩ ভাই মিলে শহরের আকুরটাকুরের বটতলায় ‘রুপসী সিনেমা’ হল করেন। মোজাহারুল ইসলাম লেলু ১৯৮৭ এবং ১৯৮৯ সালে এককভাবে এলাসিনে আশা সিনেমা এবং পাথরাইলে চৌধুরী টকিজ নামে দুটি সিনেমা হল তৈরি করেন যা এখন বন্ধ। বন্ধ হয়ে যায় ২০০৫ সালে শহরের মাঝে রওশন টকিজ। করোনেশন ড্রামাট্রিক ক্লাব পরবর্তীতে সেখানে গড়ে তুলেন সিডিসি শপিং কমপ্লেক্স। ২০০৮ সালে রুপসী সিনেমা হলটিও বন্ধ হলে সেখানেও ১০ তলা বহুতল ভবন তৈরি হয়েছে।
১৯৭৪ সালের মার্চ মাসে ১০ শতাংশ জমির উপর আফজাল চৌধুরী শহরের পূর্ব আদালত পাড়ায় তার স্ত্রী কেয়ার নামে টিন দিয়ে তৈরি করেন কেয়া সিনেমা হল। পরবর্তীতে হলের একপাশেই তিনতলা বিল্ডিং তৈরি করা হয়। শুরুর পর আশি-নব্বই দশকে জমজমাট ব্যবসা হয়। ২০১০ সালের পর থেকে সিনেমায় লোকসান হতে থাকলে ঢাকার সিনেমার প্রযোজকদের সহযোগিতায় কিছুদিন ব্যবসা চালিয়ে যান। ২০১৯ সালের জানুয়ারি মাসে তার ছেলে ফিরোজ চৌধুরী সিনেমা হলটি বন্ধ করে দেন। বর্তমানে তিন তলা ভবনটি ভেঙে ফেলা হয়েছে।
১৯৬৪ সালে প্যারাডাইস পাড়ার বাসিন্দা মন্টু চৌধুরী তার স্ত্রী আনোয়ারা চৌধুরীর উৎসাহে শহরের মেইন রোডে তিন তলার চমৎকার ডিজাইনে ভবন নির্মাণ করে নাম দেন রুপবাণী সিনেমা হল। ২০১৪ সালের দিকে সিনেমার বাজার মন্দার পাশাপাশি মালিকানা বিরোধে হলটি বন্ধ হয়ে যায়।
এছাড়া ২০১৯ সালে বন্ধ হয়ে যায় কেয়া সিনেমা হল। বাকী ছিল মালঞ্চ সিনেমা হল। সেটাও বন্ধ হয়ে হারিয়ে গেলো। সিনেমা হলের পরিবর্তে ১০ তলা মালঞ্চ টাওয়ার নির্মাণ হচ্ছে।
মালঞ্চ হলের প্রাক্তন মালিক জাহিদ মন্ডল বলেন, ৬ কোটি টাকায় এটা বিক্রি হয়ে গেছে। এখানে সিনেমা হল না থাকলেও মালঞ্চ নামটি হারিয়ে যাবে না। টাওয়ারের মাঝে ‘মালঞ্চ’ নামটি টিকে থাকবে। তবে বড় পর্দায় একটি সিনেমা দেখার আশা এখন করা যাবে না। অনেকেই হয়ত বড় পর্দায় সিনেমা দেখতে এসে মালঞ্চ টাওয়ার দেখে মনে কষ্ট নিয়ে ফিরে যাবে। তখন অনেকের মনেই টাঙ্গাইল শহরে একটি সিনেমা হল বা সিনেপ্লেক্স খুবই প্রয়োজন এটা উপলদ্ধি করবে।
নাট্যকার ও অভিনেতা সাম্য রহমান বলেন, সুস্থ সংস্কৃতির বিকাশের যে ধারা আমরা নিজেরাই নষ্ট করে ফেলছি। কর্তৃপক্ষ সিনেমা হল বাদ দিয়ে মার্কেট ও দোকান করে সাময়িক লাভ দেখছে। সিনেমা হল থাকলে যে সুস্থ জনপদ তৈরি হবে তা আমরা কখনো চিন্তা করি না। বিভিন্নভাবে সিনেমা হলগুলো ধ্বংস করা হয়েছে। একটি সময় ছিলো টার্গেট ছিলো শুধুমাত্র রিকশাওয়ালারা সিনেমা দেখবে। সে সময় ওই ধরনের সিনেমা বানানো হতো। তখন সমাজের মধ্যবিত্তরা হলে গিয়ে সিনেমা দেখা বন্ধ করে দেন। যার ফলে ধ্বংসের মুখে পড়ে সিনেমাহলগুলো।
তিনি আরো বলেন, বিচ্ছিন্নভাবে সিনেমা দেখার কিছু গ্রাহক তৈরি হলেও সাধারণ মানুষ সম্পৃক্ত হচ্ছে না। যার ফলে দেশের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের জন্য কোন উপকার হচ্ছে না। একটি সময় সিনেমা হলগুলোতে প্রচুর মানুষ হতো। আমার জানা মতে টাঙ্গাইলে এখন আর কোন সিনেমা হল থাকলো না। বর্তমানে আধুনিকায়ণের সাথে তাল মিলিয়ে সিনেমা হলগুলো টিকে থাকতে পারছে না।
টাঙ্গাইলের গণ সঙ্গীতশিল্পী এলেন মল্লিক বলেন, একটি শহরে সিনেমা হল খুবই দরকার। আকাশ সংস্কৃতি সিনেমা হলকে ধ্বংস করেছে। আকাশ সংস্কৃতি মাধ্যমে প্রবেশ করে প্রতিটি মানুষের হাতে হাতে মোবাইল ও ইন্টানেট। এতে করে জাতি ও দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আমাদের দাবি সরকারি অনুদানে টাঙ্গাইলে মানসম্মত অন্তত ২টি সিনেমা হল হওয়া দরকার। হলে বসে সিনেমা দেখার মজাই আলাদা। আর এই সিনেমা হল না হলে সংস্কৃতি চলবে না, সংস্কৃতি না বাঁচলে শিল্পী বাঁচবে না। সিনেমার পাশাপাশি নাটকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।
নয়াশতাব্দী/জেডআই
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ