নয়া শতাব্দী অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি।
নামমাত্র কাজ হলেও অফিসিয়াল নথিপত্রে কাজের অগ্রগতি দেখানো হয়েছে ৩৫ শতাংশ। ইতোমধ্যেই ছাড় করানো হয়েছে পাঁচ কোটি টাকা। কাজের বিল পরিশোধের বিপরীতে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারের নামে দেখানো হয়েছে কোটি টাকা। প্রকল্পের বরাদ্দ টাকায় মূল কাজ না করে নির্মাণ করা হয়েছে ‘রিসোর্ট’। শিক্ষা প্রকৌশল অধিদফতরের (ইইডি) কিছু কর্মকর্তা ও ঠিকাদারদের একটি অংশের সমন্বয়ে প্রভাবশালী একটি সিন্ডিকেটের যোগসাজশে এমন অনিয়ম ও লুটপাটের ঘটনা উঠে এসেছে তদন্ত কমিটির তদন্তে।
অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, ২০১৮ সালের প্রকল্পটির প্রথম দফায় মেয়াদ ছিল ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত। পরে তা আরও দুই বছর বাড়িয়ে ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত করা হয়েছে। এরপরও নির্ধারিত সময়ের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়া নিয়ে রয়েছে শঙ্কা। বরং হরিলুটে ভেস্তে যাচ্ছে শিক্ষার গুরুত্বপূর্ণ ‘৯টি সরকারি হাইস্কুল স্থাপন’ প্রকল্প। ইইডির লুটপাটের এসব টাকায় প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন না করে গাজীপুর জেলায় প্রকৌশলী ও সংশ্লিষ্ট ঠিকাদাররা মিলে একটি ‘রিসোর্ট’ নির্মাণ করছেন। শিক্ষা প্রকৌশল অধিদফতরের (ইইডি) উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের একটি টিম এ প্রকল্পের আওতায় রংপুরে একটি বিদ্যালয় নির্মাণের প্রস্তাবিত স্থান পরিদর্শনে গিয়ে এ তথ্য জানতে পান। কিন্তু টাকা ছাড়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত প্রকল্প কর্মকর্তা এবং নির্মাণ কাজের দায়িত্বে থাকা প্রকৌশলীরা প্রভাবশালী হওয়ায় এ অনিয়ম ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা হচ্ছে। এমনকি ইইডির পরিদর্শন দলের সদস্যরা এ বিষয়ে লিখিত প্রতিবেদন দেয়ার জন্য সংস্থার শীর্ষ কর্মকর্তার সম্মতি চাইলেও তা মেলেনি।
কিন্তু টাকা ছাড়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত প্রকল্প কর্মকর্তা এবং নির্মাণ কাজের দায়িত্বে থাকা প্রকৌশলীরা প্রভাবশালী হওয়ায় এ অনিয়ম ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা হচ্ছে। ইইডির পরিদর্শন দলের সদস্যরা এ বিষয়ে লিখিত প্রতিবেদন দেয়ার জন্য সংস্থার শীর্ষ কর্মকর্তার সম্মতি চাইলে তা মেলেনি বলে সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন।
জানা গেছে, রংপুর সদরের নতুন ‘কামাল কাছলা মৌজা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়’-এর জন্য ১০ তলা একাডেমিক ভবন নির্মাণ হচ্ছে। অবকাঠামোটি নির্মাণে ঢাকার একটি ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানকে কার্যাদেশ দেয়া হয়। ভবনটির নির্মাণ কাজের মোট দরপত্র মূল্য ধরা হয় ২৩ কোটি ১০ লাখ ৮ হাজার ৪৩২ টাকা। নির্মাণ কাজ ৩৬ মাসে শেষ করার কথা। কিন্তু দীর্ঘ সময় চলে গেলেও কাজ হয়েছে নামমাত্র। তবে এরই মধ্যে কাজের কোটি কোটি টাকা ছাড় করা হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ইতোমধ্যেই প্রকল্প কার্যালয় থেকে গত ২৬ জুন রংপুর অফিসের অনুকূলে (ইইডি) এক কোটি টাকা ছাড় করা হয়। পরবর্তীতে আরও প্রায় পাঁচ কোটি টাকা ছাড় হয় প্রকল্প অফিস থেকে। তবে প্রকল্পের পরিচালক (পিডি) টাকা ছাড়ের বিষয়টি অস্বীকার করেছেন। ইইডির প্রধান কার্যালয়ের সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীরাও এ অনিয়মের সঙ্গে জড়িত বলে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। নামমাত্র কাজ করে কোটি কোটি টাকা ছাড়ের বিষয়ে জানতে চাইলে ৯টি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় স্থাপন প্রকল্পের পিডি অধ্যাপক রায়হানা তসলিম বলেন, রংপুরের ওই স্কুলটির জন্য ‘আমরা টাকা ছাড় করিনি।’
তদন্তে ইইডি কর্মকর্তারা টাকা ছাড়ের প্রমাণ পেয়েছে—এমন প্রশ্নে প্রকল্পের পিডি বলেন, ‘অল্প কিছু টাকা দেয়া হয়েছে; কাজও এখন চলমান।’
এ বিষয়ে ইইডির রংপুর আঞ্চলিক অফিসের নির্বাহী প্রকৌশলী আবুল কালাম মো. আকতারুজ্জামান বলেন, আমরা হেড অফিস থেকে পাঁচ কোটি টাকা পেয়েছি। সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারকে এক কোটি টাকা দিয়েছি। বাকি টাকা ‘ইইডির ট্রেজারি’তে রয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ইইডির দুই কর্মকর্তা জানিয়েছেন, রংপুরে একটি স্কুল স্থাপনে ‘ভুল ডিজাইনে ভুল ফাইল করা’ হয়েছে। তবে এ প্রকল্পের ডিজাইনের দায়িত্বে থাকা সংস্থার নির্বাহী প্রকৌশলী ও ডিজাইনার জয়নাল আবেদীন বলেন, আমি কোনো ভুল ডিজাইন করি না। সেখানে (রংপুর) ‘ফাইলিংয়ে ভুল হয়েছে’।
জানা যায়, অগ্রিম বিল পরিশোধের পরও নির্মাণ কাজ এগুচ্ছে না বিভাগীয় পর্যায়ে নতুন ৯টি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় স্থান প্রকল্পের। এ প্রকল্পের আওতায় রংপুরে দুটি স্কুল নির্মাণের কথা রয়েছে। তবে ছয় মাসে ১০ লাখ টাকার কাজ না হওয়ায় অভিযোগের ভিত্তিতে সম্প্রতি ওই বিদ্যালয়স্থল পরিদর্শনে যান শিক্ষা প্রকৌশল অধিদফতরের (ইইডি) প্রকৌশলী ও কর্মকর্তা সমন্বয়ে গঠিত একটি উচ্চ পর্যায়ের কমিটি। তদন্তে তারা জানতে পান- টাকা আগাম ছাড় দেয়া হলেও নির্মাণ কাজ শুরুই হয়নি।
পরবর্তীতে তদন্ত কমিটি বিষয়টি সংস্থার প্রধান প্রকৌশলীকে অবহিত করলে তিনি প্রকৌশলীদের ওপর ‘ক্ষোভ’ প্রকাশ করেন। ‘পরিদর্শনের এজেন্ডায়’ এই স্কুলের নাম না থাকায় ‘ক্ষোভ’ প্রকাশ করেন প্রধান প্রকৌশলী দেলোয়ার হোসেন মজুমদার।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, ইইডির রংপুরে জোন অফিসের প্রধান এবং ওই কাজের ঠিকাদার-দুজনই ‘প্রভাবশালী’। ফলে তারা কাজের নিয়ম-কানুনের তোয়াক্কা করছেন না। অনিয়মের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রকল্প কর্মকর্তারাও সম্পৃক্ত থাকতে পারেন বলে ইইডি তদন্ত কর্মকর্তাদের ধারণা।
জানা গেছে, মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে ২০১৮ সালে একনেকে অনুমোদন পায় ৯টি মাধ্যমিক বিদ্যালয় স্থাপন প্রকল্প। ২০১৮ সালের অক্টোবরে শুরু হওয়া ‘৯ স্কুল’ প্রকল্পটির প্রথম দফায় মেয়াদ ছিল ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত। পরে মেয়াদ দুই বছর বাড়িয়ে ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত করা হয়। এ হিসাবে আগামী ছয় মাসে প্রকল্পের বাস্তবায়ন শেষ করতে হবে। ৪৬৪ কোটি টাকার এ প্রকল্পে গত জুন নাগাদ প্রায় ১৬২ কোটি টাকা ব্যয় দেখানো হয়েছে। এ হিসাবে আর্থিক অগ্রগতি দাঁড়ায় ৩৫ শতাংশের মতো। প্রকল্পটির অধীনে চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও রংপুর বিভাগীয় শহরে দুটি করে, ময়মনসিংহ বিভাগীয় শহরে ও জয়পুরহাটে একটি করে এবং সিলেট বিভাগের মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গলে একটি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় নির্মাণের কথা রয়েছে। এসব বিদ্যালয়ে থাকবে আধুনিক ভৌত অবকাঠামো সুবিধা ও যুগোপযোগী শিক্ষাসামগ্রী। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের (মাউশি) অধীনে বাস্তবায়ন হওয়া এ প্রকল্পের প্রকৃত অগ্রগতি নিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন।
বিভাগীয় শহরের ৭টি বিদ্যালয় হবে ১০ তলাবিশিষ্ট এবং জেলা-উপজেলা শহরের ২টি হবে ৬ তলাবিশিষ্ট। পর্যাপ্ত সংখ্যক শ্রেণিকক্ষের পাশাপাশি আইসিটি ল্যাব, বিজ্ঞানাগার, লাইব্রেরি, মাল্টিপারপাস হলরুম, প্রধান শিক্ষকের কক্ষ, সহকারী প্রধান শিক্ষকের কক্ষ, অফিস কক্ষ, শিক্ষক কমনরুম, নামাজের কক্ষ, দর্শনার্থী কক্ষ, বিএনসিসি, গার্লস গাইড কক্ষ, প্রাথমিক চিকিৎসা কক্ষ, মিড ডে মিল কক্ষ ও সেমিনার কক্ষ থাকবে বিদ্যালয়গুলোতে। এছাড়া ইন্টারনেট সুবিধাসহ ল্যাপটপ, কম্পিউটার ও কম্পিউটার সামগ্রী, মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর, বই-পুস্তক, খেলাধুলার সরঞ্জাম, বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি ও আসবাবপত্র সুবিধার কথাও রয়েছে।
প্রকৌশলী ও প্রকল্প কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ৯টি বিদ্যালয়ের মধ্যে অন্তত পাঁচটির অবকাঠামো নির্মাণ কাজই ‘সন্তোষজনক’ নয়। এগুলোতে কখনও কাজ হচ্ছে, কখনও বন্ধ থাকছে। ‘মনিটরিং’ হচ্ছে দায়সারা। এ কারণে আগাম বিল পরিশোধের পরও কাজ এগুচ্ছে না। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের তথ্য মতে, চট্টগ্রাম বিভাগীয় শহরের দুটি বিদ্যালয়ের জমি নির্ধারণ করতেই দুই বছর লেগে গেছে। এই শহরে বর্তমানে মোট ১০টি সরকারি বিদ্যালয় রয়েছে। শহরের মানুষের সংখ্যা বাড়লেও দীর্ঘ ৫০ বছরে নতুন কোনো সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হয়নি। তবে একটি বেসরকারি বিদ্যালয়কে গত বছর সরকারি ঘোষণা করা হয়। বাণিজ্যিক নগরী হওয়ায় এখানে জমির মূল্য চওড়া।
বিদ্যালয় নির্মাণ প্রকল্পের জন্য অন্তত দুই একর জমির প্রয়োজন। একসঙ্গে জমি না পাওয়ায় শহরের দক্ষিণের শেষপ্রান্ত পতেঙ্গায়ই দুটি বিদ্যালয় নির্মাণের জমি নির্ধারণ করা হয়। অথচ শহরের উত্তর দিকের বহদ্দারহাট, বাকলিয়া, অক্সিজেন এলাকায় সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় নেই। এই দুটি বিদ্যালয়ের মধ্যে একটির নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছে এবং আরেকটি দরপত্র প্রক্রিয়ায় রয়েছে। রাজশাহী শহরে দুটি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের জন্য বোয়ালিয়ার ছোট বনগ্রাম এবং বড় বনগ্রাম নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মধ্যে একটির কাজ শুরু হয়েছে। আরেকটির পুনঃদরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। এই শহরে বর্তমানে মোট ছয়টি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় আছে, যা স্বাধীনতার আগে প্রতিষ্ঠিত। এরপর মানুষ বাড়লেও সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় বাড়েনি। তবে গত বছর দুটি মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজকে সরকারি ঘোষণা করা হয়। এছাড়া জয়পুরহাটের বিদ্যালয়টির নির্মাণ কাজ শুরু হয়ে তৃতীয় তলার ছাদ ঢালাই পর্যন্ত হয়েছে। এই জেলায় মোট তিনটি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় রয়েছে।
রংপুর শহরের কামালকাস্তা এবং উত্তম এলাকায় সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় দুটি স্থাপনের স্থান নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মধ্যে একটির নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছে মাত্র। আরেকটির দরপত্র প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়ে কাজ শুরুর অপেক্ষায় রয়েছে। বর্তমানে এ শহরে মাত্র দুটি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় রয়েছে, যা স্বাধীনতার আগে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ময়মনসিংহ শহরের ঢাকা বাইপাস এলাকায় জমি নির্ধারণ করা হয়েছে। নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছে মাত্র। এই শহরে মোট তিনটি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় রয়েছে। এখানেও স্বাধীনতার পর কোনো সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হয়নি। এছাড়া শ্রীমঙ্গলের বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনস্টিটিউটের ভিতরে সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় নির্মাণ করা হচ্ছে। এখানে শুধু একটি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় রয়েছে। নতুন সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ তলা পর্যন্ত ছাদ ঢালাইয়ের কাজ শেষ হয়েছে।
৯টি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় স্থাপন প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক রায়হানা তসলিম বলেন, ‘বিদ্যালয় স্থাপনের জন্য জমি অধিগ্রহণ করতে হয়েছে। এ প্রক্রিয়াটি অনেক কঠিন। সেখানে অনেক ব্যক্তিমালিকানাধীন জমিও রয়েছে। এছাড়া বিভাগীয় শহরগুলোতে উন্নয়ন কর্তৃপক্ষসহ অনেক ধরনের অনুমতি লাগে। এসব কারণে দেরি হয়েছে। প্রকল্পের আর্থিক অগ্রগতি ৩৫-৪০ শতাংশ হলেও বাস্তব অগ্রগতি ৫০ শতাংশ। ২০২৩ সালের জুনে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে শেষ হবে না হয়তো। আরও এক বছর বেশি সময় লাগতে পারে।’
নয়া শতাব্দী/আরআর
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ