নয়া শতাব্দী অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি।
সাদিয়া রহমান একজন গৃহিণী। ঢাকার লালবাগ থেকে মিরপুরে যাওয়ার জন্য তিনি স্মার্টফোনের অ্যাপভিত্তিক অনলাইন পরিবহন নেটওয়ার্ক কোম্পানি উবার-এর মাধ্যমে একটি গাড়ি খোঁজেন। নিয়মানুযায়ী উবার অ্যাপে লোকেশন মার্ক করে সার্চ করতেই একটি গাড়ি পেয়ে যান তিনি। লালবাগ থেকে মিরপুর-১৩ পর্যন্ত উবার অ্যাপে ভাড়া দেখায় ৩৪৬ টাকা। সাদিয়া গন্তব্যে পৌঁছে ড্রাইভারকে ক্যাশ ৩৫০ টাকা পরিশোধ করেন। তবে, ঘণ্টাখানেক পরেই বাধে বিপত্তি। উবার অ্যাপ থেকে ‘Your driver reported that you didn’t pay the full amount’ লেখা একটা নোটিফিকেশন পান সাদিয়া রহমান। অ্যাপে ঢুকে তিনি দেখেন ওই ড্রাইভার রিপোর্ট করেছে মোট ভাড়া থেকে ১৯ টাকা ‘আনপেইড’ আছে। এরপর সাদিয়া কল করেন ওই ড্রাইভারকে। ড্রাইভার সাদিয়াকে জানান, তিনি কোন রিপোর্ট করেননি। এরপর সাদিয়া নিজেই উবারে রিপোর্ট করেন। রিপোর্ট করার পর অ্যাপে সাদিয়ার ‘আনপেইড’ এমাউন্ট দ্বিগুণ বেড়ে ১৯ টাকা থেকে ৩৮ টাকা হয়ে যায়। পরবর্তী ট্রিপ খোঁজার আগেই সাদিয়াকে এই টাকা পরিশোধ করতে হয়। গৃহিণী সাদিয়া রহমানের সঙ্গে এ ঘটনাটি ঘটে গত ২০ জানুয়ারি।
২৩ জানুয়ারি প্রায় একইরকম ঘটনা ঘটে রিমঝিম গ্রুপের জেনারেল ম্যানেজার মইনুল হক তন্ময়ের সঙ্গে। উত্তরা থেকে নিকুঞ্জ-১ আসার পর তার ফোনেও আসে ‘আনপেইড’ মেসেজ। ২৮ জানুয়ারি ভুক্তভোগী হন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার রাকিব উল ইসলাম। সেদিন উবার অ্যাপের মাধ্যমে গাড়ি ভাড়া করে রাজধানীর বাসাবো থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজে যান তিনি। আরও অসংখ্য ভুক্তভোগী নিজেদের এরকম বাজে অভিজ্ঞতা শেয়ার করেছেন ফেসবুকে ‘রাইড শেয়ার ইউজার গ্রুপ অব বাংলাদেশ’ নামক উবার ব্যবহারকারীদের একটি গ্রুপে। এ ছাড়াও কমপক্ষে ১৫ জন ভুক্তভোগীর সঙ্গে সরাসরি কথা হয় এই প্রতিবেদকের।
ভুক্তভোগী গৃহিণী সাদিয়া রহমান নয়া শতাব্দীকে বলেন, সেদিন উবার সিএনজিতে মিরপুরে গেলাম। ভাড়া দেখাচ্ছিল ৩৪৬ টাকা, নামার সময় ৩৫০ টাকা দিলাম। বাসায় যাওয়ার পর দেখলাম ড্রাইভার নাকি রিপোর্ট করেছে- ট্রিপের মোট ভাড়া থেকে ১৯ টাকা আনপেইড। পরের দিন ওই ড্রাইভারকে কল করে জিজ্ঞেস করলাম। ড্রাইভার বললেন, আপনি তো ফুল ক্যাশ পেমেন্ট করেছেন। আমি কোনো রিপোর্ট করিনি। পরে আমি উবারের অ্যাপ ও ফেসবুকে কমপ্লেইন করলাম। তবুও আমার সমস্যাটা সমাধান হয়নি, বরং ‘আনপেইড’ এমাউন্ট দ্বিগুণ বেড়ে ১৯ টাকা থেকে ৩৮ টাকা হয়ে যায়।
গৃহিণী সাদিয়া সেদিন যে গাড়িতে ভ্রমণ করেছিলেন তার চালক উসমানের সঙ্গে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। উসমান নয়া শতাব্দীকে বলেন, একদিন এক নারী যাত্রীকে গন্তব্যে পৌঁছে দেয়ার কিছুক্ষণ পর তিনি কল করে জানতে চাইছিলেন যে আমি উবারে কোন রিপোর্ট করেছি কিনা। আমি তাকে জানালাম কোনো রিপোর্ট করিনি। সেই যাত্রী আমাকে ভাড়ার থেকেও বিশ টাকা বেশি দিয়েছিলেন, আমি কেন তার নামে রিপোর্ট করব! উসমান জানান, ওই নারী যাত্রীর কল পেয়ে তিনি উবারে কল করেন। উবারে কল করে তিনি প্রশ্ন করেন, তিনি কোনো যাত্রীর বিষয়ে রিপোর্ট করেননি তাহলে যাত্রী কেন তাকে কল করে রিপোর্ট করেছে কিনা জানতে চাচ্ছে?
চালক উসমান বলেন, ওই যাত্রী আমাকে বিশ টাকা বেশি দিয়েছে এটাও আমি উবারকে জানিয়েছি। উবার থেকে আমাকে বলেছে, ‘আপনার চিন্তা করার দরকার নাই, আপনি আপনার মতো চালাতে থাকেন। যাত্রীর সঙ্গে আমরা কথা বলে নেব।’
আরেক ভুক্তভোগী সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার রাকিব উল ইসলাম নয়া শতাব্দীকে বলেন, সমস্যাটা হয় ২৮ জানুয়ারি। আমি বাসাবো থেকে ঢাকা মেডিকেল গিয়েছিলাম। প্রথমে আমাকে ভাড়া দেখিয়েছিল ২৫০ টাকা। কিন্তু গন্তব্যে যাবার পরে ভাড়া আসে ২৪০ টাকা, আমি টিপসসহ ড্রাইভারকে ২৬০ টাকা দিই। এর ঘণ্টাখানেক পর আমি আবার যখন ঢাকা মেডিকেল থেকে বাসাবো ব্যাক করব তখন দেখি যে আমি নাকি মোট ভাড়ার ১১ টাকা পে করি নাই! রিসিপ্ট চেক করার পরে দেখি ২৪০ টাকা ভাড়ার সঙ্গে বুকিং ফি যোগ হয়ে আছে এক্সট্রা ১০ টাকা। তখন ফেরার তাড়া ছিল তাই ওই ১১ টাকা পে করেই উবার সার্চ করি। পে না করা পর্যন্ত উবার সার্চ করা যায় না।
রাকিব বলেন, বাসাবো ব্যাক করার পরও সেম অবস্থা। ২৫০ টাকার ভাড়া এলো ২৪০ টাকা। টিপসসহ ২৫০ টাকা পে করার কিছুক্ষণ পর আবারও মেসেজ আসে- আমি নাকি ড্রাইভারকে ১২ টাকা কম দিয়েছি। পরে ড্রাইভারকে ফোন করলে তিনি জানাল- কোনো রিপোর্ট তিনি করেননি। এরপর সমাধান খোঁজার জন্য উবার ইউজার গ্রুপে পোস্ট করি। কিন্তু কোনো সমাধান পাইনি। তিনি বলেন, এরপরে এক কলিগ সাজেস্ট করে উবারের টুইটার পেইজে নক দিতে। আমি টুইটারে সক্রিয় না, তাই উবারের ফেসবুকে নক করি। কিন্তু লাভ হয়নি। উবারের ইন্সটাগ্রাম পেইজেও নক করি। ওখান থেকে রিপ্লাই আসে। আর কয়েক ঘণ্টা পর দ্বিতীয় যে ‘আনপেইড এমাউন্ট’টা ছিল ওটা উবার থেকে রিমুভ করে দেয়।
রাকিব উল ইসলাম বলেন, এটা এক প্রকার ভোগান্তি। যারা জানেন না তারা অনেকেই টাকা পে করবে বারবার। আমি মনে করি এটা একটা টেকনিক্যাল সমস্যা। কিন্তু এটা সমাধান করার জন্য দেশে কোনো হেল্পলাইন না থাকাটা দুঃখজনক। আর বিষয়টি ইচ্ছাকৃত হলে তা অব্যশই প্রতারণা।
রিমঝিম গ্রুপের জেনারেল ম্যানেজার ভুক্তভোগী মইনুল হক তন্ময় নয়া শতাব্দীকে বলেন, একাধিকবার এরকম সমস্যায় পড়েছি। এটা অবশ্যই এক ধরনের প্রতারণা। প্রতিদিন এক লাখ যাত্রীর থেকে গড়ে বিশ টাকা করে কেটে নিলে অঙ্কটা বিশ লাখে দাঁড়ায়। এ ছাড়াও যাত্রী হয়রানির আরও বহু অভিযোগ আছে উবারের বিরুদ্ধে। যথাযথ কর্তৃপক্ষের নজরদারি থাকলে উবারের এ প্রতারণা থেকে কিছুটা হলেও রেহাই পাওয়া যেত।
উবারে ভোগান্তির শিকার আরেক ভুক্তভোগী জাফর ইকবাল নয়া শতাব্দীকে বলেন, উবার কল করলে প্রথমে রিসিভ করে। তারপর কল করে কোথায় যাব এবং ভাড়া কত দেখাচ্ছে সেটা জিজ্ঞেস করে। এরপর তার মনমতো হলে যায় না হলে ক্যানসেল করে দেয়। পরে আবার রাইডার খুঁজতে হয়। দূরত্ব কম হলে অনেক সময় বাইক পাওয়াই কষ্টকর হয়ে যায়। এটা একটা কঠিন বিড়ম্বনা।
এ বিষয়ে কথা বলতে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)’র চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মদ মজুমদারের মুঠোফোনে একাধিকবার কল করে এবং খুদেবার্তা পাঠিয়েও যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। তবে, নামপ্রকাশ না করার শর্তে বিআরটিএ’র এক কর্মকর্তা নয়া শতাব্দীকে জানান, তারা এরকম অভিযোগ পাননি এখনও, অভিযোগ পেলে অবশ্যই বিষয়টি ক্ষতিয়ে দেখবেন। তিনি বলেন, উবারের এরকম অনৈতিক কাজ করার কোনো সুযোগ নেই। যদি তারা এটি করে তাহলে অবশ্যই আমরা ব্যবস্থা নেব।
বিষয়টি নিয়ে জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের মহাপরিচালক এ. এইচ. এম. সফিকুজ্জামান বলেন, উবারের বিষয়ে নানা অভিযোগ থাকলেও এ অভিযোগটি সম্পূর্ণ নতুন। উবারের এসব বিষয় নিয়ে আমরা সম্প্রতি একটা মিটিং করেছি। আমরা একটা রিপোর্টও তৈরি করছি। রিপোর্টের জন্য বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ চলছে। রিপোর্টটি তৈরি হলে আমরা বিআরটিএ-সহ যথাযথ কর্তৃপক্ষকে জানাব।
এ. এইচ. এম. সফিকুজ্জামান আরও বলেন, কোনো ভোক্তা যদি স্পেসিফিক অভিযোগ করেন, তাহলে আমরা অভিযুক্তকে ধরতে পারি। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী নয়া শতাব্দীকে বলেন, এ ধরনের অভিযোগ আমরা এর আগে শুনিনি। যদি এরকম কিছু ঘটে, তবে নিঃসন্দেহে সেটা একটা প্রতারণা। এক্ষেত্রে যারা প্রতারিত হচ্ছে তাদের এগিয়ে আসতে হবে। কর্তৃপক্ষের নজরে বিষয়টি আনতে হবে। অভিযোগের বিষয়ে জানতে উবার বাংলাদেশের জনসংযোগ কর্মকর্তা আসাদের মুঠোফোনে কল করা হলে তিনি বলেন, ‘ভাই আমি খুব অসুস্থ। তাই কথা বলতে পারছি না।’ এরপর উবার কর্তৃপক্ষের সঙ্গে ইমেইল, ভেরিফায়েড ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রাম পেইজে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।
নয়া শতাব্দী/আরআর
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ