শনিবার, ০১ এপ্রিল ২০২৩, ১৮ চৈত্র ১৪২৯

বাংলা ভাষা সম্পর্কে জিন্নাহর ধারণা ছিল খুবই কম

প্রকাশনার সময়: ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০৮:৪১

পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ যে বাঙালি এবং তার ভাষা যে বাংলা— এ সম্পর্কে জিন্নাহর ধারণা ছিল খুবই কম। তিনি মনে করতেন পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষই উর্দুভাষী। জিন্নাহ ছিলেন একজন গুজরাটি, ইংরেজিতে অত্যন্ত দক্ষ। উর্দু ভালো জানতেন না।

ইতিহাস মতে, পাকিস্তানের রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, আমলা থেকে শুরু করে প্রভাবশালীদের বড় অংশ ছিলেন উত্তর ভারত থেকে আগত উর্দুভাষী। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, লিয়াকত আলী খান থেকে শুরু করে পাকিস্তানের উচ্চ পদবিধারীরা ছিলেন উর্দুভাষী মোহাজের। জিন্নাহ ও তার উত্তরসূরি লিয়াকত আলীর মন্ত্রিসভাকে তাই ‘মোহাজের মন্ত্রিসভা’ বলা হতো। ১৯৪৭-৫৮ পর্যন্ত পাকিস্তানের মোট ২৭ জন গভর্নর জেনারেল/প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী, প্রাদেশিক গভর্নর ও মুখ্যমন্ত্রীর মধ্যে ১৮ জন ছিলেন মোহাজের। এদের আবার বেশিরভাগের ভাষা ছিল উর্দু। যে কারণে প্রথমে থেকেই শ্রেণি স্বার্থে তারা উর্দু ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে ছিলেন। এমনকি নাজিমুদ্দিন যিনি পূর্ববাংলার উচ্চপদে আসীন হয়েছিলেন তিনি ছিলেন উর্দুভাষী।

স্বভাবতই তারা ও পশ্চিম পাকিস্তানি জনগোষ্ঠী রাজনীতি, অর্থনীতিসহ সর্বত্র নিজেদের প্রাধান্য বজায় রাখার জন্য এ ভাষাকে বেছে নেয়। পশ্চিম পাকিস্তানিরা বহুদিন থেকে দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে উর্দুকে চর্চা করায় তারা উর্দুর বিরুদ্ধে কোনো প্রতিবাদ করেনি। মুসলিম লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা ও প্রভাবশালী অংশ পশ্চিম পাকিস্তানি হওয়ায় তারা সবাই এ ভাষার পক্ষে ছিলেন। তবে পূর্ববাংলায় এর প্রতিবাদ ওঠে। কারণ পূর্ববাংলায় কখনই উর্দু চর্চা হয়নি। বাঙালিরা গণতন্ত্র, জনসংখ্যাধিক্য ইত্যাদি কারণে ৫৬% বাংলাভাষীদের ভাষা বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা দাবি করেছে। এর সঙ্গে জড়িত ছিল রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থ। সব যুক্তি উপেক্ষা করে প্রশাসন, অর্থনীতির কেন্দ্রসহ পশ্চিম পাকিস্তান ও কেন্দ্রের রাজধানী স্থাপিত হয় করাচিতে।

মুসলিম লীগের প্রভাবশালী অংশের সেখানে অবস্থানের ফলে স্বাভাবিকভাবে পশ্চিম পাকিস্তান সমৃদ্ধ এলাকা এবং পূর্ববঙ্গ অবহেলিত এলাকায় পরিণত হয়। বৈদেশিক ঋণের সিংহভাগের ব্যবহার, উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের বড় অংশ পশ্চিমে সম্পাদনের ফলে বঞ্চিত পূর্ববঙ্গবাসীদের বুঝতে অসুবিধা হয়নি যে পাকিস্তান সৃষ্টির ফলে শুধু শাসকের বদল হয়েছে। ব্রিটিশ শোষণের বদলে পাকিস্তানি শোষকের আবির্ভাব হয়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয় রাজনীতি, প্রশাসনসহ চাকরি ও পদের ক্ষেত্রে বাঙালিদের বঞ্চিত করার নীতি।

উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার কথাবার্তা শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই পূর্ব বঙ্গের ছাত্র, শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সমাজ, বুদ্ধিজীবী আর রাজনীতিবিদরা বুঝেছিলেন যে এটা বাঙালিদের জন্য চরম বিপর্যয় ডেকে আনবে। তারা বুঝলেন, এর ফলে পাকিস্তানে উর্দুভাষীদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হবে, বাঙালিরা সরকার ও সামরিক বাহিনীতে চাকরি-বাকরির সুযোগের ক্ষেত্রে উর্দু জানা জনগোষ্ঠীর তুলনায় পিছিয়ে পড়বেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ফলে বাঙালি মুসলমানদের উন্নয়ন ও সামাজিক বিকাশের স্বপ্ন সৃষ্টি হয়েছিল— তা চরমভাবে ব্যাহত হবে। অথচ পাকিস্তানের বাস্তবতা ছিল এই যে সে দেশের পূর্বাংশে এবং গোটা দেশ মিলিয়েও সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভাষাই ছিল বাংলা। পশ্চিম পাকিস্তানে ৪০ শতাংশের কিছু বেশি লোকের ভাষা ছিল পাঞ্জাবি। মাত্র চার শতাংশের ভাষা ছিল উর্দু। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভাষা হয়েও বাংলা ভাষা পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হবে না— এটা পূর্ববঙ্গের ছাত্র ও শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর মধ্যে প্রচণ্ড ক্ষোভ সৃষ্টি করেছিল।

তমদ্দুন মজলিস এই সময় ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু’ নামে একটি পুস্তিকা প্রকাশ করেছিল। এতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরে অধ্যাপক ড. কাজী মোতাহার হোসেন, দৈনিক ইত্তেহাদের সম্পাদক আবুল মনসুর আহমদ, তমদ্দুন মজলিসপ্রধান অধ্যাপক আবুল কাসেমের নিবন্ধ ছিল। আবুল মনসুর আহমদ লিখেছিলেন, “উর্দূকে রাষ্ট্রভাষা করিলে পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষিত সমাজ রাতারাতি ‘অশিক্ষিত’ ও সরকারি চাকুরির ‘অযোগ্য’ বনিয়া যাইবেন”— ঠিক যা ঘটেছিল ব্রিটিশরা ফারসির জায়গায় ইংরেজিকে ভারতের রাষ্ট্রীয় ভাষা করার পর ভারতের মুসলিম শিক্ষিত সমাজের ক্ষেত্রে। ‘ভাষার প্রশ্নটি যে পাকিস্তানের এক অংশের ওপর আরেক অংশের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ আধিপত্য বিস্তারের সঙ্গে জড়িত’ এ বোধ তখন সবার মধ্যে জন্মাতে শুরু করেছে— বলেছিলেন আবুল মনসুর আহমদ ।

ওই পুস্তিকায় একটি চমকপ্রদ কথা লিখেছিলেন কাজী মোতাহার হোসেন তার নিবন্ধে। তিনি লিখেছিলেন, ‘...যদি গায়ের জোরে উর্দুকে বাঙালি হিন্দু-মুসলামের ওপর রাষ্ট্রভাষা রূপে চালাবার চেষ্টা হয়, তবে সে চেষ্টা ব্যর্থ হবে। কারণ ধূমায়িত অসন্তোষ বেশি দিন চাপা থাকতে পারে না। শিগগিরই তাহলে পূর্ব-পশ্চিমের সম্বন্ধের অবসান হবার আশঙ্কা আছে।’ অর্থাৎ, উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করলে পাকিস্তানের বাঙালিদের ক্ষোভ যে এক সময় জাতীয়তাবাদী চিন্তায় রূপ নেবে এবং তা যে পাকিস্তানের বিভক্তি যেকে আনতে পারে— ড. হোসেন তা তখনই অনুভব করেছিলেন।

জিন্নাহের মতো পাকিস্তানের নেতারাও তাদের দৃষ্টিকোণ থেকে হয়তো ঠিক সেই আশঙ্কাই করেছিলেন। জিন্নাহ ঢাকায় দেয়া তার ভাষণগুলোতে বারবার বলেছিলেন যে বাংলা ভাষার দাবি যারা করছে তারা ‘প্রাদেশিক’ মানসিকতায় আক্রান্ত এবং উর্দু একমাত্র রাষ্ট্রভাষা না হলে তা পাকিস্তানের ‘ঐক্য-সংহতি ও ধর্মীয় বৈশিষ্ট্য’ নষ্ট করবে। তিনি বলেছিলেন যারা রাষ্ট্রভাষা বাংলার কথা বলছে, তারা পাকিস্তানকে ধ্বংসের ষড়যন্ত্রের অংশ। মোহাম্মদ আলি জিন্নাহ ঢাকায় যে বক্তৃতা দিয়েছিলেন তার অংশবিশেষ এখন ইন্টারনেটে শুনতে পাওয়া যায়।

নয়া শতাব্দী/আরআর

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ