নয়া শতাব্দী অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি।
উন্মুক্ত জায়গায় মলত্যাগ বন্ধে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে। তবে স্বাস্থ্যকর পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা নিশ্চিত করা এখনও চ্যালেঞ্জ হিসেবে রয়ে গেছে। আর তাই দেশের ২৫টি শহরে অন্তর্ভুক্তিমূলক স্যানিটেশনের ব্যবস্থা বাস্তবায়নে উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এতে ব্যয় ধরা হয়েছে দুই হাজার ২১০ কোটি ৭০ লাখ টাকা।
এ কাজ বাস্তবায়ন করবে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতর। মেয়াদ ২০২২ সালের অক্টোবর থেকে ২০২৭ সালের জুন পর্যন্ত। এরই মধ্যে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় গত ১৭ জানুয়ারি এ প্রকল্প অনুমোদন দেয়া হয়। নিরাপদ স্যানিটেশন শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা বিশ্বই এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছে উল্লেখ করে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম বলেন, সারা দেশে সুপেয় পানি সরবরাহে ওয়াটার গ্রিড লাইন স্থাপনে একটি মাস্টার প্ল্যান প্রণয়নে স্ট্যাডির কাজ চলছে। শহরব্যাপী ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক স্যানিটেশন বা সিটি ওয়াইড ইনক্লুসিভ স্যানিটেশন’ স্যানিটেশনের সামগ্রিক ইস্যুকে প্রাধান্য দেয়। এটি সবার জন্য সমতাভিত্তিক, নিরাপদ এবং টেকসই স্যানিটেশন সমাধান নিশ্চিত করায় বিশ্বব্যাপী গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে।
ইউনিসেফের ২০১৩ সালে পরিচালিত একটি জরিপে দেখা যায়, বাংলাদেশে একই টয়লেট একাধিক ব্যক্তি ও পরিবারের ব্যবহারের হার অনেক বেশি এবং শহরের বস্তিগুলোতেই তা সবচেয়ে বেশি। বাংলাদেশে মৌলিক পরিচ্ছন্নতা বা হাইজিন সম্পর্কে মানুষের ধারণা খুব ভালো। তবে পরিচ্ছন্নতার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ ঠিকমতো হাত ধোয়ার অভ্যাস খুব একটা নেই।
বাংলাদেশ ব্যাংকের টেকসই অর্থনীতি বিভাগের মহাব্যবস্থাপক খন্দকার মোর্শেদ মিল্লাত বলেন, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বা এসডিজি-৬ অর্জনে দরকার স্যানিটেশন খাতে অর্থায়নের উপায় খুঁজে বের করা। দেশজুড়ে বিস্তৃত ওয়াশ সেবা পারে বাংলাদেশকে পরিচ্ছন্ন, নিরাপদ ও সমৃদ্ধ করতে। পানি ও স্যানিটেশন, অর্থাৎ ওয়াশ খাতে অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থায়নে কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে পৌঁছানো সম্ভব হবে বলে মনে করেন তিনি। তাছাড়া সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা এবং নতুন নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবনের মাধ্যমে ওয়াশ খাতে উন্নয়ন সম্ভব।
প্রকল্পের উদ্দেশ্য ও প্রধান কার্যক্রম: বাংলাদেশের জেলা শহরের ২৫টি পৌরসভায় নিরাপদ ও টেকসই স্যানিটেশন সিস্টেম এবং সুষ্ঠু বর্জ্য ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে জনস্বাস্থ্য, জীবনযাত্রার মান ও পরিবেশ ব্যবস্থার উন্নয়ন করা।
১২ হাজার ৩১২টি হাউজহোল্ড ল্যাট্রিন ও এক হাজার ৩৫০টি কমিউনিটি ল্যাট্রিন স্থাপন করা। এছাড়া ১৩০টি পাবলিক টয়লেট ও ১৭৩টি ডি-ওয়াট সিস্টেম, ৩১ হাজার ৪৯৬টি পয়ঃবর্জ্য ধারক বা কন্টেইনমেন্ট সিস্টেম ও ২৭টি পয়ঃবর্জ্য বা ফেকাল স্লাজ ড্রাইং সিস্টেম, ৩০টি কঠিন বর্জ্য বা সলিড ওয়েস্ট ব্যবস্থাপনা প্লান্ট (সর্টিং, কম্পোস্টিং, ল্যান্ড ফিলিং, তরল বর্জ্য পরিশোধন বা লিচেট ট্রিটমেন্ট) এবং ৩২টি কঠিন ও পয়ঃবর্জ্য পরিশোধন, সম্পদে পরিবর্তন, পুনঃব্যবহার ও রূপান্তরের লক্ষ্যে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবস্থা করা। এছাড়া ৩৪৭ কিলোমিটার বিভিন্ন ধরনের আরসিসি ড্রেন, ৩০টি উৎপাদক নলকূপ, ১০০ কিলোমিটার পাইপলাইন, ১০০টি ডিস্লাজিং ট্রাক ও ৫০টি ডাম্প ট্রাক, ২৭০টি কঠিন বর্জ্য সংগ্রাহক ভ্যান ও ৮১০টি হ্যান্ড ট্রলি এবং ২৫টি এক্সক্যাভেটর কেনা হবে।
পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান বলেন, ২৫ শহরে অন্তর্ভুক্তিমূলক স্যানিটেশন প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে দেশের ২৫টি জেলা শহরের সদর পৌরসভায় নিরাপদ স্যানিটেশন হবে। এতে করে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার উন্নয়নের মাধ্যমে শহরের পরিবেশ সংরক্ষণ এবং স্বাস্থ্য ও জীবন-যাত্রার মান উন্নয়ন করা সম্ভব হবে।
জয়েন্ট মনিটরিং প্রোগ্রাম ২০২১, প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে ৩৯ শতাংশ জনগণ নিরাপদ ব্যবস্থাপনার স্যানিটেশন সুবিধার আওতায় আছে অর্থাৎ ১০০ জনের মধ্যে দেশের ৬১ শতাংশ মানুষ নিরাপদ স্বাস্থ্যসম্মত স্যানিটেশনের বাইরে। সারা বিশ্বে ৪.২ বিলিয়ন মানুষ ‘নিরাপদ পয়ঃনিষ্কাশন’ ছাড়াই বাস করে এবং বিশ্বব্যাপী প্রায় ৬৭৩ মিলিয়ন মানুষ খোলা জায়গায় শৌচকর্ম করে। খোলা জায়গায় শৌচকর্ম করা বিশেষভাবে নারী এবং মেয়েদের পক্ষে কঠিন। নারীরা অধিক গোপনীয়তার জন্য অন্ধকারকে বেছে নেয়, কিন্তু তারপরেও রাতে একা থাকলে আক্রমণের ঝুঁকি থেকে যায় এবং এতে মানব বর্জ্য ছড়িয়ে ভূগর্ভস্থ পানি সম্পদকে দূষিত করে।
এছাড়া জনশুমারি ও গৃহগণনা ২০২২-এর প্রাথমিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, জাতীয় পর্যায়ে ৫৬.০৪৫ খানায় ফ্লাশ করে/পানি ঢেলে নিরাপদ পয়ঃনিষ্কাশনের ব্যবস্থা আছে এবং ১.২৩ ভাগ খানায় টয়লেট ব্যবস্থা নাই। উন্মুক্ত স্থানে মলত্যাগ বন্ধ হলেও মানববর্জ্য ব্যবস্থাপনা এখন স্যানিটেশনের নতুন চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে।
জানা গেছে, জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ২০১০ সালের ২৮ জুলাই পানি ও পয়ঃনিষ্কাশনের অধিকারকে মানবাধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। পয়ঃনিষ্কাশন (শৌচালয়) সুবিধার অভাব জনস্বাস্থ্য, সম্ভ্রম এবং সুরক্ষার উপর প্রভাব ফেলে। মাটিবাহিত হেলমিনথিয়াসিস, ডায়রিয়া, শিস্টোসোমিয়াসিস এবং শিশুদের অস্বাভাবিক স্বল্পবৃদ্ধিসহ বহুবিধ রোগের কারণ ও বিস্তারের সঙ্গে শৌচালয়ের অভাব অনেকাংশে সম্পর্কিত। এখনো দেশের জনগণের বড় একটা অংশ উন্নত স্যানিটেশন সুবিধা থেকে বঞ্চিত এবং ৭৭ শতাংশ খানা যৌথ টয়লেট ব্যবহার করে। স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী তাজুল ইসলাম বলেন, বর্তমানে বাংলাদেশের বেসিক স্যানিটেশন কাভারেজ প্রায় শতভাগ। উন্মুক্ত স্থানে মলত্যাগের হার শতকরা মাত্র একভাগ। মন্ত্রী আরও বলেন, স্যানিটেশনের সাফল্য পর্যালোচনাপূর্বক এ কথা বলা যায়—পরিবেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ উন্নত স্যানিটেশন ব্যবস্থা।
তিনি বলেন, সানিটেশনের ক্ষেত্রে আমরা যে সাফল্য অর্জন করেছি সেটি ভুলে গেলে চলবে না। স্যানিটেশন নিশ্চিত করতে স্বাস্থ্যসম্মত ল্যাট্রিন স্থাপন পূর্বশর্ত হলেও ল্যাট্রিন ব্যবহার, হাত ধোয়ার অভ্যাসসহ প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যাভ্যাস মানুষের মধ্যে তৈরি হচ্ছে কিনা তা নিশ্চিত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
জানা গেছে, বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে ১৯৭১ সালে ল্যাট্রিন ছিল শতকরা ১ ভাগেরও কম বাড়িতে। সারা দেশে টিউবওয়েল ছিল দুই লাখেরও কম। ঢাকা-চট্টগ্রাম শহরসহ মাত্র ৭৬টি পৌরসভায় ছিল পাইপ দিয়ে পানি সরবরাহের ব্যবস্থা। অর্থাৎ স্বাধীনতার সংগ্রামের সময় এবং শত্রুমুক্ত বাংলাদেশে পানি ও স্যানিটেশনের অবস্থা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে নাজুক অবস্থায় ছিল। পৃথিবীর সব দেশের পানি ও স্যানিটেশন এবং স্বাস্থ্য আচরণবিধি নিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও ইউনিসেফের যৌথ কর্মসূচির যে প্রতিবেদন ২০২১ সালের ১ জুলাই প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায় ভারত, নেপাল ও পাকিস্তানে এখনো ১৫ শতাংশের ওপরে মানুষ খোলা মাঠে পায়খানা করে। অথচ বাংলাদেশ ২০১৫ সালের মধ্যেই খোলা মাঠে পায়খানার হারকে শূন্যে নামিয়ে এনেছে এবং গত সাত বছর শূন্য হারকে ধরে রেখেছে।
নয়া শতাব্দী/আরআর
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ