নয়া শতাব্দী অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি।
মাদক চোরাচালান ও মানবপাচার রোধে এবার টেকনাফের নাফ নদের চারপাশ ও তলদেশে বিশেষ ক্যামেরা বসানো হচ্ছে। কিন্তু এসব ক্যামেরার অবস্থান জানতে পারবে না কেউ। ক্যামেরা স্থাপন কাজে নিয়োজিতদের ক্যামেরার অবস্থানের তথ্য ফাঁস না করতে বিশেষ নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
আর ক্যামেরাগুলো প্রতিনিয়ত মনিটরিং করা হবে ঢাকা থেকে। মনিটরিংয়ের দায়িত্বে থাকবে পুলিশেরই বিশেষ একটি সংস্থা। সম্প্রতি পানিপথে ইয়াবা, আইসের মতো মাদক চোরাচালান ও মানবপাচারের ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে এমন উদ্যোগ নেয়া হয়েছে বলে পুলিশের একটি সূত্র জানিয়েছে।
জানা গেছে, প্রায় প্রতিদিনই টেকনাফের নাফ নদ দিয়ে দেদার বাংলাদেশে আসছে বড় বড় ইয়াবার চালান। নানা পরিকল্পনা নিয়েও ইয়াবার চালান ঠেকানো যাচ্ছে না। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা চালান আটক করছে। পাশাপাশি ধরা খাচ্ছেন ইয়াবা কারবারিরা।
মিয়ানমার থেকে একাধিক চক্র চালান নিয়ে আসছে। আর এ কাজে সহায়তা করছে কতিপয় রাজনৈতিক নেতা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর অসাধু সদস্যরা। আবার তালিকার পর তালিকা করা হচ্ছে প্রতিনিয়ত। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। কারবারি ও চালান পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে করতে এবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নতুন ধরনের ওই উদ্যোগ নিয়েছে।
জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেন, দেশ থেকে মাদক নির্মূল করতে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো কাজ করে যাচ্ছে। বিশেষ করে ইয়াবা কারবারিদের প্রতিরোধ করতে বেশ কিছু পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। ইয়াবার চালান সবচেয়ে বেশি আসে মিয়ানমার থেকে। এ কারণে নাফ নদে নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে। এই নদ দিয়ে ইয়াবার চালান যাতে আর আসতে না পারে সেই জন্য কিছু উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, বর্তমানে মিয়ানমার থেকে সীমান্ত দিয়ে টেকনাফে ইয়াবা পাচারে কোনো বিনিয়োগ লাগে না। নির্দিষ্ট ব্যক্তির কাছে ইয়াবা নিরাপদে পৌঁছানোর পর মিয়ানমারের মাদক ব্যবসায়ীদের কাছে টাকা পরিশোধ করতে হয়। বাহকের কাজ হচ্ছে নির্দিষ্ট ব্যক্তির কাছে টাকা জমা দিয়ে আকর্ষণীয় কমিশন নিয়ে নেয়া। ফলে মিয়ানমার থেকে পাঠানো ইয়াবা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর হাতে ধরা পড়লেও উদ্ধারের সংখ্যা খুবই কম।
নাফ নদী দিয়েই আসছে বেশি চালান। দিনে দিনে চালানের ঘটনা আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে যাওয়ায় দুশ্চিন্তায় পড়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পুলিশ সদর দফতর। পরে পুলিশ সদর দফতরের নির্দেশে গোয়েন্দা ইউনিটগুলো নাফ নদ ঘিরে বিশেষ অনুসন্ধান চালায়।
অনুসন্ধানে তথ্য উঠে আসে-নতুন কারবারিরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। এমনকি যারা আত্মসমর্পণ করেছে তারাও ইয়াবা কারবার চালাচ্ছে। টেকনাফের আলিয়াবাদের আমিনুর রহমান, পশ্চিম লেদারের নুরুল হুদা মেম্বার, উত্তর লেঙ্গুর বিলের দিদার মিয়া, মুন্ডারডেইলের শাহেদ রহমান নিপু, মধ্যজালিয়াপাড়ার মোজাম্মেল হক, দক্ষিণ জালিয়াপাড়ার জোবায়ের হোসেন, কুলালপাড়ার নুরুল বছর, কাউন্সিলর ওরফে নুরসাদ, শিলবুনিয়াপাড়ার কামরুল হাসান, ডেইলপাড়ার আবদুল আমিন, একই এলাকার নুরুল আমিন, চৌধুরীপাড়ার শফিকুল ইসলাম ওরফে শফিক, একই এলাকার ফয়সাল রহমান, নাজিরপাড়ার এনামুল হক ওরফেছ এনাম মেম্বার, মৌলভীপাড়ার একরাম হোসেন, নাজিরপাড়ার সৈয়দ হোসেন, আলিরডেইলের শাহেদ কামাল, সাবরাংয়ের মৌলভী বছির আহম্মদ, পুরাতন কল্যাণপাড়ার শাহ আলম, নাজিরপাড়ার আবদুর রহমান, রাসেল প্রমুখ নাফ নদী দিয়ে চালান নিয়ে আসছে। আর তাদের সহায়তা করছে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার একশ্রেণির দুর্নীতিবাজ সদস্য। তাদের শনাক্ত করার কাজ শুরু হয়েছে।পুলিশ সূত্র জানায়, ইয়াবার চালান প্রতিরোধ করতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একটি বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছে। নাফ নদের চারপাশ ও তলদেশে বিশেষ ক্যামেরা বসাতে কাজ শুরু করে দিয়েছে। ক্যামেরাগুলো দিনে ও রাতে সক্রিয় থাকবে। কারা কারা নদ দিয়ে আসা-যাওয়া করছে সেই চিত্র পাওয়া যাবে।
এসব মনিটরিং করবে পুলিশের একটি সংস্থা। সরাসরি ঢাকা থেকে ক্যামেরাগুলো মনিটরিং করা হবে। সেখানে সন্দেহজনক কিছু চোখে পড়লে তাৎক্ষণিক আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে জানানো হবে। এতে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হবে। এ জন্য সীমান্তে অবস্থানকারী আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের ভিতরেও সমন্বয় গড়ে তোলা হবে।
সূত্রমতে, বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের ৬৩ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য আর ১ হাজার ৩৬৪ মিটার নাফ নদ। কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলার হোয়াইক্যং ইউনিয়ন থেকে শুরু করে সাবরাং ইউনিয়নের শাহপরীরদ্বীপ পর্যন্ত এই নদের পাড়ে অন্তত সাত হাজার মানুষ বসবাস করেন। ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট এ নদ দিয়ে বানের পানির মতো প্রবেশ শুরু করে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী।
মাদক পাচার ও রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের কারণ দেখিয়ে মাছ ধরা বন্ধ রাখলেও নাফ নদ দিয়ে প্রতিদিন ইয়াবা উদ্ধার হচ্ছে। নদ দিয়ে মাদক পাচারের ভয়াবহতা দেখা যায় জেলা পুলিশের এক পরিসংখ্যানেও। ২০২২ সালে এক বছরে এ নদ দিয়ে পাচার হয়ে আসে ৯০০ কোটি টাকার বেশি ইয়াবা ও আইস। নানা অভিযানে ২ হাজার ৩১০টি মামলায় মোট ৩ হাজার ৯৩ জনকে গ্রেফতারও করা হয়।
এর আগে ২০২১ সালে টেকনাফে ২৮৫ কোটি টাকার মাদক, স্বর্ণ ও বিভিন্ন চোরাই পণ্য জব্দ করা হয়। সর্বশেষ গত ৯ ফেব্রুয়ারি টেকনাফে বিজিবির পৃথক অভিযানে ১.২৫৮ কেজি ক্রিস্টাল মেথ আইস, ২১,৯১০ পিস ইয়াবা ট্যাবলেট এবং বার্মিজ মদ ও বিয়ারসহ একজন মাদক পাচারকারীকে আটক করা হয়।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পুলিশ সদর দফতরের ঊর্ধ্বতন দুই কর্মকর্তা বলেন, নাফ নদের চোরাকারবারীদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে দেশে ৯০ শতাংশ মাদক কারবারি ও সেবনকারীদের নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হবে। এই নদ দিয়ে প্রতিদিনই মিয়ানমার থেকে ইয়াবার চালান আসছে। আমরা নিশ্চিত হয়েছি চোরাকারবারিদের সহায়তা করছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর কতিপয় সদস্য। আর এই কারণে আমরা নাফ নদের বিভিন্ন স্থানে বিশেষ ক্যামেরা বসানোর উদ্যোগ নিয়েছি। ক্যামেরাগুলো এমনভাবে বসানো হবে যাতে কেউ কিছু বুঝতেই না পারে। এ জন্য এরই মধ্যে একটি বাজেট ধরা হয়েছে। প্রথম দফায় অন্তত ২০০ ক্যামেরা বসানো হবে।
ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, প্রথম অবস্থায় পানির নিচে ১০০ এবং নদীর চারপাশ ঘিরে ১০০ ক্যামেরা বসানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। কোন কোন স্থানে ক্যামেরা বসানোর কাজ শুরু হবে তাও চিহ্নিত করা হয়েছে। সব কিছু ঠিকঠাক থাকলে এ বছরের মধ্যেই ক্যামেরা বসানোর কাজ শেষ হবে বলে ওই কর্মকর্তা জানান।
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ